সম্পাদকের পাতা

উত্তর আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস

নজরুল মিন্টো

সম্প্রতি চমকে উঠার মতো একটি তথ্য উদঘাটন করেছেন টরন্টোর বিশিষ্ট সাংবাদিক মাইকেল শেপার্ড। তিনি গত ছয় মাস ধরে বৃহত্তর টরন্টোর ২৯টি হাইস্কুলের ১০১৯টি শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়ে যে তথ্য প্রদান করেছেন তা পড়ে পুলিশ প্রশাসন, অন্টারিও সরকার, যাদের ছেলে মেয়ে হাইস্কুলে যায় তাদের মাথা ঘুরছে।

প্রাক কথন ঃ
ষাটের দশকে লসএঞ্জেলস-এ কালো আমেরিকানদের মাধ্যমে গ্যাং সন্ত্রাসীদের যাত্রা শুরু। তারা ‘ক্রিপস’ নামে ঐ এলাকায় পরিচিত হয়। সদস্যদের বয়স ছিল ১২ থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত। একই সময়ে ‘ব্রাড’ নামে আরেকটি গ্যাং শহরের পশ্চিম প্রান্তে উৎপাত শুরু করে। এর পর অল্প সময়ের ভেতর প্রায় একশতটি ছোট ছোট দল ঐ দুই গ্যাং-এর সাথে জড়িয়ে যায়। ১৯৮০ সালে পুলিশের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৫০০০ কিশোর এবং তরুণরা গ্যাংগুলোর সদস্যপদ লাভ করে। আজ এই দুই গ্রুপের সদস্যরাই পুরো উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সদস্য সংখ্যা কত হতে পারে অনুমান করতেও ভয় হয়।
আজ প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সাধারণ বিষয়ের মতো অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সেরা দেশ কানাডার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যে সন্ত্রাস বিস্তার লাভ করেছে তা শুনে কেউ কেউ আশ্চর্য হলে হতে পারেন তবে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

একটি সাধারণ ঘটনা ঃ
টরন্টোর জারভিস কলিজিয়েটে স্পাদাইনা গার্লস নামের গ্যাং-এর সদস্যরা কিম চেন নামে একটি মেয়েকে হেস্তনেস্ত করে। প্রথমে তারা কিমের কাছে গিয়ে বলে তার লাষ্ট নেম বদল করতে। কারণ তাদের গ্যাং লিডারের লাষ্ট নেমও একই হওয়াতে তারা অপমান বোধ করছে। কিম প্রথমে ভেবেছিল তারা হয়তো তার সাথে কৌতুক করছে। বিষয়টা যে কৌতুক নয় তা সে টের পেলো ঐ মাসেরই তৃতীয় সপ্তাহে। তারা তাকে ঐদিন লাথি মেরে ফেলে দেয় এবং মারধোর করে। টানা হেঁচড়া করার সময় কিম গ্যাং লিডারের জ্যকেট খামচে ধরে এবং এর খানিকটা ছিঁড়ে যায়। এতে তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং কিমের কাছে ঐ জ্যাকেটের দাম হিসেবে ৮০ ডলার দাবী করে। নববর্ষের দিন তারা কিমকে আবার ধরে এবং এবার ২০০ ডলার দাবী করে। এ অর্থ না দিলে তারা তার আঙুল কেটে ফেলবে অথবা মেরেও ফেলতে পারে বলে হুমকি দেয়।

পরে ডাউন টাউনের একটি ক্লাব ঘরে স্পাদাইনা গার্লসরা আবার কিমকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়; এ সময় কিমের বয়ফ্রেন্ড এগিয়ে আসলে সিলভার বয়েজ-এর সদস্যরা স্পাদাইনা গার্লসের পক্ষ নিয়ে তাকে ছুরিকাঘাত করে এবং তার কান কেটে ফেলে।

এটা মাত্র একটি ঘটনা। এ রকম হাজারো ঘটনা ঘটছে এই মেগাসিটিতে। দিন দিন শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। মারামারি, ছুরিকাঘাত এগুলো এখন নিয়মিত রুটিনের অংশ। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলে যেতে ভয় পায়। সাহস করে তাদের অভিভাবকদেরও ঘটনাগুলো জানায় না। টরন্টোতে শিক্ষার পরিবেশ এখন মারাত্মক হুমকীর সম্মুখীন।

ছাত্রদের সাথে আলাপ করে যেসব বিষয় জানা যায়, তাহলো ঃ
১। ৫৩% শিক্ষার্থীরা জানায় তাদের স্কুলে গ্যাং রয়েছে।
২। ১০% (১০২) শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা গ্যাং-এর সাথে জড়িত। এর মধ্যে ২৬ জন বালিকা।
৩। ৩০% শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা স্কুলে মারামারি করে।
৪। ১৩% শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা স্কুলে অস্ত্র নিয়ে যায়।
৫। ৪৮% শিক্ষার্থী জানে কাদের কাছে অস্ত্র রয়েছে।
৬। ৮৭% শিক্ষার্থী স্কুলের প্রিন্সিপাল বা কোন শিক্ষকের কাছে নির্যাতিত কিংবা হুমকীর সম্মুখীন হয়েও অভিযোগ করে না।
৭। ৩০% শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা তাদের অভিভাবকদের কাছে হুমকী বা মারামারির কথা বলে। (এরা বেশিরভাগ নতুন ইমিগ্রেন্ট)
৮। প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী জানিয়েছে সে স্কুলে যেতে ভয় পায় এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে।

টরন্টোর ১৪ বছরের এক বালক বলছে সন্ত্রাসীরা খামাখা ঝগড়া করে। তাদের কারো দিকে তাকালেও শার্টের কলার ধরে জিজ্ঞেস করে কেন তাকানো হলো।

ইটোবিকো শহরের এক বালক জানায়, সে প্রতি সপ্তাহে গ্যাং লিডারকে ২০ ডলার দেয় যাতে তাকে কেউ না মারে।
টরন্টোর ১৬ বছরের একটি বালিকা জানিয়েছে গ্যাং-এর একটি মেয়ে সব সময় তাকে আক্রমণ করে এবং একদিন তার চুল কেটে দিয়েছে।

নর্থ ইয়র্কের গ্যাং-এর সাথে জড়িত এক বালক জানায়, তারা আগ্নেয়াস্ত্রের অংশগুলোকে ভাগ করে করে স্কুলে নিয়ে যায় এবং লকারে লুকিয়ে রাখে। একটি মেয়ে বলেছে, সে তার মা বাবাকে স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে এজন্যেই জানায় না যে, যদি তারা তাকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন।

বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা বলেছে, তারা স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কে অভিভাবকদের জানায় না এজন্যেই যে, যদি অভিভাবকরা স্কুলে এসে অভিযোগ করেন এবং সন্ত্রাসীরা টের পায় তবে ঐদিনই তাদের ওপর হামলা হতে পারে।

শিক্ষকরাও গ্যাংদের ভয় পান। গ্যাং-এর ছেলে মেয়েরা শিক্ষকদের দিকে কলম ছুঁড়ে মারে, থুতু নিক্ষেপ করে, এমনকি কাছে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এ বছরের এপ্রিল মাসে হারবার্ড কলিজিয়েটের একজন শিক্ষককে দশম শ্রেণীর এক ছাত্র সুইমিং পুলের সামনে গুলি করে রিভলবারটি বাইরে ফেলে দিয়ে নিশ্চিন্তে তার ক্লাসে ফিরে আসে। স্কুলের শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা এখন সাধারণ বিষয়। শিক্ষার্থীরা জানে শিক্ষকদের অক্ষমতা। এজন্যই তারা অভিযোগ করে না। আবার অনেকের ধারণা, যদি সে অফিস কক্ষে রিপোর্ট করতে যায় এবং কোনভাবে যদি গ্যাং-এর সদস্যরা দেখে ফেলে তবে ঘটনা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। জানা গেছে, প্রায় স্কুলে গ্যাং-এর ছেলেরা বিভিন্ন উপায়ে মেয়েদের সম্ভ্রম হানি ঘটিয়ে থাকে।

বেশ কিছুদিন আগে একজন মনস্তাত্ত্বিক নিজ উদ্যোগে দেখতে চেয়েছিলেন কেন ছেলেমেয়েরা এসব করছে কিন্তু কোন স্কুল, কোন শিক্ষা বোর্ড তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি। বরং বলেছে এ বিষয়ে তাদের কোন উৎসাহ নেই। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সন্ত্রাস চলছে তা স্কুল কর্তৃপক্ষ চায়না এ তথ্য প্রকাশ করে তাদের স্কুলের সুনাম নষ্ট হোক। শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষও চায় না তাদের বোর্ডের দুর্নাম হোক। যে কারণে এই ভয়াভহ চিত্রটি জনসমক্ষে এতদিন আসতে পারেনি।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা পুলিশকে জানায় না এ কারণে যে তারা তাদের বিশ্বাস করে না; আর স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানায় না কারণ তারা মনে করে এরা কিছু করতে পারবে না।
পুলিশ বলেছে এ পর্যন্ত তারা বৃহত্তর টরন্টোর ১৮০টিরও বেশি গ্যাং-এর তালিকা তাদের খাতায় লিপিবদ্ধ করতে পেরেছে। তবে তাদের দমন করার মতো কৌশল বা শক্তি যে এখনও তাদের হয়নি তা গ্যাংগুলোর কর্মকা-ই প্রমাণ।

এবারে কিছু গ্যাং এর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিচ্ছি-

ট্রাইফ কিডস ঃ তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। এলাকা হচ্ছে-নর্থ ইয়র্ক (জেইন ষ্ট্রীট এবং ফিঞ্চ এভিনিউ) থেকে ডাউন টাউন টরন্টোর পার্লামেন্ট এবং ডানডাস। সদস্য সকলেই বালক। নির্দিষ্ট কোন জাতি নেই। এরা বিভিন্ন দেশের; তবে সাদা চামড়ার সদস্য কম।

এদের চিহ্ন হচ্ছে-টি, এলটি অথবা এলটি লেখা উলকি। এরা ব্রাডস-এর অনুসারী।

সিলভার বয়েজ ঃ তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। এলাকা হচ্ছে ডাউন টাউন টরন্টো, স্পাদাইনা এভিনিউ এবং কলেজ ষ্ট্রীট হয়ে ব্রডভিউ এবং জেরার্ড ষ্ট্রীট পর্যন্ত। এই দলের সদস্য সকলেই ভিয়েতনামিজ। এদের চিহ্ন হচ্ছে -চুলের কিছু অংশ কমলা অথবা লাল রঙের থাকবে।

লা ফেমিলিয়া ঃ তাদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। এলাকা হচ্ছে স্কারবোরোর মারখাম রোড এবং লরেন্স এভিনিউ ইষ্ট। তবে এরা বেশিরভাগ সাবওয়েতে ভ্রমন করে। এই দলের সদস্যরা বেশিরভাগ স্প্যানিশ এবং ছেলে মেয়ে উভয়ই আছে। এদের চিহ্ন হচ্ছে-এলএফ লেখা উলকি থাকবে গায়ে অথবা তিনটি ফোটা থাকবে। তিন ফোটার অর্থ হচ্ছে মাই ক্রেজি লাইফ।

ছোট ছোট গ্যাং কতগুলো আছে তার হিসেব পাওয়া পুলিশের জন্যও কষ্টকর। চরমপন্থী যেগুলোর খবর পাওয়া গেছে সেগুলো হলো ঃ ইয়ং গানস, ১৮ বুদ্ধা, পেন্টাগন, লিঞ্চ মব, গ্যাটরস, ঘেটো গার্লস, রেডি ক্রু, রুকুস গার্লস, স্পাদাইনা গার্লস, ইয়ং থাগস, ইয়ং লুটার্স, পাঞ্জাব মাফিয়া, লুনি টুনস, টিনি টুনস, সিক্স বয়েজ, ইত্যাদি। ‘আনটাচেবল’ নামে বহুজাতিক গ্যাংটি শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে।

কোনো কোনো দলের মধ্যে ছেলে মেয়ে উভয়েই রয়েছে আবার শুধু ছেলেদের এবং শুধু মেয়েদের নিয়েও গ্যাং রয়েছে। মেয়েদের নিয়ে ৫টি গ্যাং-এর তালিকা পুলিশের খাতায় রয়েছে। গ্যাং সদস্য প্রত্যেকের বয়স ১৫ থেকে ১৬। জানা গেছে, মেয়েদের গ্যাং-কে ছেলেরা সাংঘাতিক ভয় পায়। এরা ভয়ঙ্কর বলে তাদের ধারে কাছে কেউ ঘেষে না। পুলিশের একজন মহিলা কনষ্টেবল জানিয়েছেন, ছেলেদের চাইতে মেয়েরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত বেশি। তিনি জানিয়েছেন ১২ থেকে ১৭ বছরের মেয়েদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ গত দশ বছরে ১৭৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র গত বছরেই ৫২৯টি রেকর্ড পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

একেক গ্যাং-এর সিগন্যাল যেমন আলাদা তেমনি তাদের চুলের ষ্টাইল, পোশাক, জুতো, গায়ের উলকি বা চিহ্নও আলাদা থাকে। যেমন টরন্টোর লুনি টুনস গ্যাং-এর সদস্যদের হাতের সিগন্যাল হচ্ছে ‘বি’। তারা ‘ব্রাড’কে অনুসরণ করে। তাদের পোশাক লাল রং-এর থাকে। ‘ক্রিপস’ এর সদস্যদের পোষাক হচ্ছে নীল। যারা বিশ্বস্ত তাদের আবার নিজস্ব ভাষাও রয়েছে। ‘বাড’ এর সদস্যরা সি দিয়ে যত শব্দ আছে তারা সেটাকে বি দিয়ে শুরু করবে। যেমন ‘কফি’কে তারা বলে ‘বফি’।

ভুল সিগন্যালের কারণে এক গ্যাং এর সদস্য অন্য জায়গায় গেলে তার জীবন নাশ হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে।

দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে অনেকে ছুরি দিয়ে নিজের শরীর কেটে বিভিন্ন সিগন্যাল লিখে রাখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গ্যাং-এর একজন সদস্য জানায়, দলের প্রথম সারির নেতা হতে গেলে (তাদের ভাষায় গ্র্যাজুয়েশন) শুরুতে তাকে যে কাজ করতে হবে তা হলো যে কোন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে লুট করা।

গ্যাং সদস্যদের প্রায় প্রত্যেকের কাছে রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র। তারা গাড়ি চুরিসহ এমন কোন কাজ নেই যা করতে সাহস করে না। গ্যাং-এর সস্যদের ধারণা-দলের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হলে মারামারি, চুরি চামারি এগুলো করতে হবে। তাই ছোটখাটো চুরি থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত এরা করতে দ্বিধা করে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সন্ত্রাস দূর করার জন্য শিক্ষাবিদ, পুলিশ, মনস্তত্ববিদরা এখন বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। কি করা যায়। কি উপায়। এর সমাধান কোথায় তারা ভেবে দেখছেন।

Back to top button