সম্পাদকের পাতা

সিঙ্গেল পেরেন্ট ও কানাডার হতভাগ্য শিশুরা

নজরুল মিন্টো

উন্নত বিশ্বের নাগরিকরা দেরীতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ৩০ বছর থেকে ৩৫ বছর হচ্ছে ষ্ট্যান্ডার্ড। তা ছেলে হোক আর মেয়ে হোক। টরন্টোতে একবার ষাটোর্ধ্ব এক মহিলার সাথে দেখা বাস ষ্টেশনে। এ কথা সে কথার পর জিজ্ঞেস করলাম তার ছেলে মেয়ে ক’জন। আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললো, আমার তো বিয়েই হয়নি। উল্টো আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। (পরে জানতে পারলাম উত্তর আমেরিকায় বয়স কত, বিবাহিত কি না, বাচ্চা ক’জন, কোন ধর্মের অনুসারী এসব জিজ্ঞেস করা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না)।

এখানে কেউ বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে গেলে অনেক ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকদিন ধরে এক সাথে থেকে একে অন্যকে পরীক্ষা করে; অবশেষে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পরে তারা বিয়ের প্রস্তুতি নেয়। সম্প্রতি এক জরিপে জানা গেছে, কানাডিয়ান পরিবারগুলোতে দ্রুত গতিতে অবিবাহিতদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কানাডার ৭.৮ মিলিয়ন পরিবারের মধ্যে এক চতুর্থাংশেরও বেশি এখন সিঙ্গেল পেরেন্টস। যেখানে বিবাহিত পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১.৭% হারে সেখানে সিঙ্গেল পেরেন্টস এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১৯%। এছাড়া অবিবাহিত (কমন’ল) দম্পতির সংখ্যা বাড়ছে বিবাহিত দম্পতির চাইতে ১৬ গুণ বেশি।

জরিপে আরও জানা যায়, অবিবাহিত দম্পতিগুলো তখনই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় যখন তারা মনে করে তাদের সন্তান দরকার। কিন্তু এটা কেবল মুখে মুখে। বাস্তব অবস্থা আবার অন্যরকম। হিসেবে দেখা যাচ্ছে অবিবাহিত দম্পতিদের সংখ্যা বেশি। কানাডাতে বর্তমানে ৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ৯শ ৫০টি অবিবাহিত দম্পতির সন্তান রয়েছে। এদিকে যখন এ অবস্থা তখন অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে জন্মহার দ্রুত গতিতে কমে যাচ্ছে।

এ মহাদেশে বিবাহ করার চাইতে বিবাহ-বিচ্ছেদ হলো এক্সপেনসিভ। সে ভয়েও অনেক লোকে বিয়ে করতে চায় না। তারপরও বিয়ে হয়, বিচ্ছেদও হয়। সম্প্রতি নতুন এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডার প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের বাবা-মা বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে এবং এ ঘটনা শিশুর জন্মের ৫ বছরের মধ্যেই ঘটেছে। (সূত্র : স্ট্যাটিসটিকস কানাডা)

কানাডার অবিবাহিত দম্পতির প্রায় অর্ধেকের বাস কুইবেক প্রদেশে। জানা যায়, মনট্রিয়লের পরিবারগুলোর মধ্যে এক তৃতিয়াংশেরও বেশি অবিবাহিত দম্পতি। টরন্টো, ভ্যাঙ্কুভার এবং অটোয়াতে এ সংখ্যা খুবই কম। বৃহত্তর টরন্টোর ১.১ মিলিয়ন পরিবারের মধ্যে মাত্র ৬% অবিবাহিত দম্পতি। তারপরও অন্টারিও প্রদেশে বর্তমানে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫শ ৫০টি শিশুর পিতামাতা অবিবাহিত।

ভ্যানিয়ার ইনষ্টিটিউট অব দ্য ফ্যামিলির একজন মুখপাত্র বলেন, বিগত কয়েকটি জেনারেশন ধরে প্রচলিত কমন’ল প্র্যাকটিস খুবই জনপ্রিয়। আর বিবাহ প্রথার ওপর কানাডিয়ানদের বিশ্বাস লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তিনি আরও বলেন, কে বা কারা চার্চে গিয়ে বিয়ে করবে, নাকি অন্য কোনভাবে করবে এটা তার বা তাদের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। তবে কিছু কিছু পরিবার রয়েছে তারা তাদের বিশ্বাস এবং প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে যাচ্ছে। বর্তমানে অবিবাহিত দম্পতির সংখ্যাধিক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন এ সংখ্যা কানাডিয়ান ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

কানাডায় প্রতি ৫ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু বড় হচ্ছে সিঙ্গেল পেরেন্ট-এর তত্ত্বাবধানে। এর মধ্যে বেশিরভাগই মায়ের কাছে। আর এসব মায়েদের অধিকাংশ হচ্ছে গরিব। এই ধরণের মায়েরা কাজও করতে পারে না। যেহেতু ডে কেয়ারে রাখার মতো সামর্থ্য তাদের নেই, কিংবা পরিবারের অন্য কেউ তাদের সহযোগিতাও করে না তাই বাচ্চারা বড় হওয়া পর্যন্ত এরা ওয়েলফেয়ারের ওপর নির্ভরশীল থাকে। জানা যায়, সিঙ্গেল পেরেন্ট মায়েরা বেশিরভাগই নির্যাতনের শিকার। অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। আর এই নেশার খরচ যোগাতে গিয়ে অপরাধ জগতের সাথেও জড়িয়ে যায় কেউ কেউ।

গবেষনা করে দেখা গেছে, যেসব শিশু সিঙ্গেল পেরেন্টদের কাছে বড় হচ্ছে এরা মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। এদের স্বাস্থ্য খারাপ থাকে, লেখাপড়ায়ও তারা দুর্বল। আসলে তারা অযত্নে-অবহেলায় বেড়ে উঠছে। ১৯৭৩ সালে প্রায় ১২% ছেলে-মেয়ে এ বয়সের মধ্যে তাদের বাবামার বিবাহ-বিচ্ছেদ হতে দেখেছে। ১৯৬৩ সালে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৬.৫%। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, এসব শিশুদের একটি বিরাট অংশ তাদের বাবাকে আর কোনোদিন দেখেনি। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৬% ছেলে-মেয়ে তাদের মায়ের সঙ্গে বসবাস করে। অন্যদিকে মাত্র ৭% বাবার সঙ্গে বসবাস করে এবং ৫৮% ছেলে-মেয়ে মাসে একবার মাত্র তাদের বাবার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। এদিকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ ছেলে-মেয়ে কমন’ল (বিয়ে বহিভূর্ত দাম্পত্য জীবন) সম্পর্কের বাবা-মার ঘরে বড় হয় এবং আলাদা হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে। অন্যদিকে বিবাহিত বাবা-মার কাছে থেকে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে ১৪% ছেলে-মেয়ে।

গবেষকরা জানিয়েছেন কমন’ল দম্পতিদের চাইতে বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে বিচ্ছেদের ঘটনা অনেক কম। গবেষকরা আরও জানিয়েছেন যে, দিন দিন বিচ্ছেদ-পরিবারের শিশুদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। স্ট্যাটিসটিক্স কানাডা জানিয়েছে দেশের মোট শিশুর সংখ্যা ৯ লক্ষ ৪০ হাজার। এর অর্ধেকেরও বেশি হলো বিচ্ছেদ-পরিবারের এবং তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, বেশিরভাগ সন্তানকে তাদের বাবা সহায়তা করছে না। দেখা গেছে, আদালত থেকে নিদের্শ দেয়ার কারণে ৫৩% শিশুকে তাদের বাবা প্রথম দুই মাস ঠিকই সাহায্য করে, এরপর তারা সাহায্য করতে গড়িমসি শুরু করে। শুনলে অবাক লাগলেও সত্য, আদালতের বাইরে যেসব সমঝোতা হয় সেসব শিশুদেরকে তাদের বাবা ঠিকই সাহায্য করে যায়।

ফ্রান্স, জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়াতে সিঙ্গেল মাদারদের সরকার অগ্রিম অর্থ প্রদান করে। সরকার সন্তানের বাবার কাছ থেকে যেভাবে ট্যাক্স আদায় করে একই নিয়মে এ অর্থও আদায় করে ছাড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে সন্তান বড় হওয়া পর্যন্ত বাবার ওপর নূন্যতম একটি অর্থ প্রদান করার দণ্ড দেয়া হয়। বাকি অর্থ সরকার প্রদান করে। অর্থ দেয়া-নেয়া বড় কথা নয়। গবেষকরা বলছেন, বিচ্ছেদের বোঝা সন্তানের মানসিকতার ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে সেটাই মানুষের ভাববার বিষয়।

মেট্টো টরন্টোতে প্রতি তিনজন শিশুর একজন দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করছে। লরা নামে একজন প্রতিবেদক সম্প্রতি এই তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানান রোববার রাতে টনি (ছদ্মনাম) নামের এক মহিলা এবং তার তিনটি শিশু মিলে প্রতিবেশির ঘরের সামনে রাখা ব্যাগগুলো চুপিসারে নিয়ে আসে। পুরনো কাপড়ের এ ব্যাগগুলো রাখা হয়েছিল ‘সলভেশন আর্মি’র দোকানে দান করার জন্যে। টনিকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায়, যদিও খারাপ লাগছিল এ কাজটি করতে তবু সে নিয়ে এসেছিল। টনি আরও জানায়, ‘যদিও আমাদের দেখতে গরিব মনে হয় না তবু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে কাল সকালের ব্রেড কোত্থেকে আসবে আমি জানি না।’

টনির ১১ বছর বয়স্ক পুত্র এলিয়ট জানায়, ‘স্কুলে যখন অন্যান্য ছাত্ররা আমাকে পুরনো কাপড় পরিধানে দেখে তখন আমাকে নিয়ে তারা হাস্য কৌতুক করে এবং আমার ইচ্ছে করে স্কুলে আর না যেতে।’ টনির দুই কন্যা পাঁচ বছরের ক্যালি এবং তিন বছরের অ্যানা তাদের পরিবারের আর্থিক সঙ্গতির কথা এ বয়সে উপলব্ধি করতে পারে না কিন্তু এলিয়ট ভালভাবেই বুঝে। সে জানে তার পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি নেই; তবুও তার ইচ্ছে করে আইসক্রিম খেতে, তার বোনদের চুলের রিবন কিনে দিতে কিংবা স্কুলের টিফিনে কিছু খেতে। এলিয়ট আরো জানায়, কোন কোন দিন এমনও হয় যে, গ্রোসারী কেনার জন্যেও তার মার কাছে পয়সা থাকে না। ঐ দিন সে লাঞ্চে কোন কিছু খেতে পারে না। লাঞ্চরুমে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এ সময় সহপাঠিরা কেউ দয়া করে তাকে তাদের খাবারের অংশ বিশেষ দেয়; তবে সেটা উচ্ছিষ্ট।

গত বছর ক্যালির কিণ্ডারগার্টেন ক্লাশের সকল ছাত্র ছাত্রী যখন ম্যাকডোনাল্ড খেতে যায় তখন সে যেতে পারেনি। কারণ অংশগ্রহণের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তা তার মা দিতে পারেনি। ম্যাকডোনাল্ড ষ্টোর থেকে তার এক সাথী ঐদিন অর্ধেক হামবার্গার ক্যালির জন্যে নিয়ে এলে সে অত্যন্ত খুশী হয় এবং দৌঁড়ুতে দৌঁড়ুতে বাসায় নিয়ে আসে। টনি জানায়, আমার শিশুর খুশি দেখে আমার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামতে থাকে। উল্লেখ্য, একটি ম্যাকডোনাল্ড হামবার্গারের দাম মাত্র ১ ডলার ১২ সেন্ট।

টনির শিশুরা হচ্ছে মেট্টো টরন্টোর ৩৬ শতাংশ গরীব শিশুদের অংশ। রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা মারভিন নোভিক বলেন, ‘আমাদের সমাজ এখন ভারসাম্যহীন অবস্থায় এগুচ্ছে। মানুষের ওপর প্রচন্ড ঝামেলা। অনেকেই নুন্যতম মানের জীবন যাপন করতে পারছে না। এসব পরিবারের পিতামাতারা বাচ্চাদের একটি বই কিনে দিতে পারে না, স্কুলের ফি-ও দিতে পারে না।’ মারভিন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এতে শিশুদের স্বাস্থ্য এবং মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে। বিভিন্ন সংস্থা জরিপ চালিয়ে একই কথা স্বীকার করেছে। মেট্টো টাস্ক ফোর্স তাদের রিপোর্টে বলেছে, টরন্টোতে ৮৯,০০০ শিশু যাদের বয়স দশ বছরের নীচে তারা গরীব এবং মানবেতর জীবন যাপন করছে।

উল্লেখ্য, মেট্টো টরন্টোতে প্রতি তিনটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারের বাৎসরিক গড় আয় হচ্ছে ৬৬,৪৪১ ডলার। অন্যদিকে, সর্ব নিম্ন আয় হচ্ছে ৭ হাজার ডলার। রিচার্ড শিলিংটন নামে একজন লেখক ‘কানাডিয়ান ফ্যাক্ট বুক অন পভার্টি’ বইতে ২১ হাজার ডলার পর্যন্ত যেসব পরিবারের বাৎসরিক আয় রয়েছে তাদেরকে গরীব বলে মন্তব্য করেন।

বর্তমানে টরন্টোতে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার গৃহহীন লোক রয়েছে। এদের মধ্যে ৩৫০০ ব্যক্তিকে এবং ৬শত পরিবারকে মেট্টো সাময়িক শেল্টার দিয়েছে। একজন ফুড ব্যাঙ্কের কর্মকর্তা জানান, দৈনিক যেসব লোক তাদের এখানে খেতে আসে তাদের অর্ধেক হলো এখন শিশু।

Back to top button