সম্পাদকের পাতা

হ্যাপি নিউ ইয়ার

নজরুল মিন্টো

আরেকটি নতুন বছরে পা রাখতে যাচ্ছি আমরা। ঘটানাবহুল বিগত সাল এখন অতীত। অতীত ছাড়বার পাত্র নয়। অতীতের বোঝা বয়ে যেতে হয়। আমাদের পূর্ব পুরুষেরাও বয়ে গেছেন, আমরাও বয়ে যাবো। অবশ্য আজকাল কেউ অতীত নিয়ে অতশত চিন্তা করে না। নিরন্তর পরিবর্তনশীল এ পৃথিবীতে অতীত নিয়ে চিন্তার অবকাশ নেই কারো। জ্ঞানীরা বলেন, অতীত থেকে কেবলই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। অতীত হচ্ছে ভবিষ্যতের সিঁড়ি। তাইতো দেখি ভবিষ্যতের পানে ছুটে চলছে মানুষ। বর্তমান নিয়েও মানুষের তেমন ভাবনা নেই। যত ভাবনা ভবিষ্যত নিয়ে। সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মানে মানুষ ছুটছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। উন্নত ভবিষ্যতের আশায় মানুষ যেতে চাচ্ছে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে।

আগের তুলনায় মানুষের গতি বেড়ে গেছে। গতির সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে জীবনের দৈর্ঘ্য। মানুষ আরো গতিশীল হতে চায়। শব্দের আগে, আলোর আগে যেতে চায়। মানুষ জীবনের দৈর্ঘ্য আরও বৃদ্ধি করতে চায়। সত্তর, আশি, নব্বই…। প্রতিটি মুহুর্ত কাজে লাগাতে চায়; প্রতিটি ক্ষণকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে চায় আজকের মানুষ।

নববর্ষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন জাতি নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। নতুন বছরকে নানানভাবে স্বাগত জানায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের ধারণা নববর্ষ মানে নতুন করে জীবনের শুরু। প্রায় ভাষাগোষ্ঠীর নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে। তদুপরি ইংরেজী নববর্ষ হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। দেখা যায়, দেশে দেশে ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে নানান রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। আকাশ সংস্কৃতি এই প্রস্তুতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বলতে গেলে বিশ্বজুড়ে নববর্ষ উদযাপনের ধাঁচ এখন একই রকম।

নববর্ষের প্রচলন নতুন কিছু নয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে চার হাজার বছর আগে ব্যবিলনীয়রা নববর্ষ উদযাপন শুরু করে। তখনও সৌর বছর চালু হয়নি। বসন্তকালীন সময়ে চান্দ্রমাসের প্রথম দিন থেকে এ উৎসবের সূচনা হতো। এক নাগাড়ে এগারো দিন এ উৎসব চলতে থাকতো। উৎসবের প্রতিটি দিনের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ছিল। এখনকার মতো সেসময়ও মানুষ নববর্ষের প্রাক্কালে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করতো; দেনা শোধ করতো; কারো কাছ থেকে কোন কিছু ধার নিয়ে এলে তা ফেরত দিতো।

খৃষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে রোমানরা জানুয়ারীর ১ম তারিখ থেকে সাল গননা শুরু করে এবং ঐদিনটিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রোমান দেবতা জানাস-এর নাম থেকে জানুয়ারী নামকরণ করা হয়। খৃষ্টপূর্ব ৪৬ সালে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সীজার উল্লিখিত সৌর বছর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। সে জন্যে এটাকে জুলিয়ান ক্যালে-ার বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সে সময় ৪৪৫ দিনে বছর গণনা করা হতো।

সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের ধারণা-নববর্ষের দিনে যা খাবে, যা পরবে সারা বছর সেভাবেই চলবে। সে কারণে এখনও নববর্ষের প্রাক্কালে সবাই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে উদযাপানের প্রস্তুতি নেয়। পার্টির আয়োজন করে। পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের ধারণা এদিন যদি কোন অতিথি ঘরে আসে সে হয় শুভ হয়ে আসবে, অথবা অশুভ হয়ে আসবে। তবে দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী মনে করা হয় দীর্ঘদেহী, কালো চুলের অধিকারী অতিথি হচ্ছে শুভ লক্ষণ।

নববর্ষের দিনে বিভিন্ন দেশে নানান ধরনের মেলা ও খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। শীত প্রধান দেশগুলোতে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার, টরন্টোর নাথান ফিলিপস স্কোয়ার, মনট্রিয়লের মলসন সেন্টারে হাজার হাজার মানুষ রাত বারোটা পর্যন্ত কাউন্ট ডাউন করার জন্যে অপেক্ষায় থাকে। এদিন বিভিন্ন শহরে আলোর খেলা দেখানো হয়। ধর্মপ্রাণ যারা তারা নতুন বছরটিতে পদার্পন করতে পেরেছে বলে ইশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে চার্চে যায়। বিভিন্ন সংগঠন নববর্ষের পার্টির আয়োজন করে থাকে। অনেকে ঘরোয়াভাবেও পার্টির আয়োজন করে থাকে।

বহু লোক আছেন যারা নববর্ষের দিন নানান ধরনের প্রতিজ্ঞা করে থাকেন। জানা যায়, ধুমপান ত্যাগ করার প্রতিজ্ঞা হচ্ছে এই তালিকায় শীর্ষে। দ্বিতীয় হচ্ছে পারতপক্ষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার না করা। নববর্ষের আগের রজনী অর্থাৎ নিউ ইয়ার্স ইভ-এর মন্দ দিকটি হচ্ছে এ রাতে কিছু লোক অতিরিক্ত সুরা পান করে বেসামাল হয়ে যায়। বিভিন্ন রেষ্টুরেন্ট, ক্লাবে হতাহত হওয়ার খবর আসে। গাড়ি দূর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। বেঘোরে প্রাণ হারায় নিরীহ মানুষজন। এই মন্দ দিকটি অপসারণের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরের কতিপয় ব্যক্তি একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। নাম- ‘ফার্ষ্ট নাইট প্রমোটস এলকোহল ফ্রি ফ্যাষ্টিভ্যালস’। তারা নামী-দামী শিল্পীদের সমন্বয়ে বিশাল অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে থাকেন। অনুষ্ঠানমালায় কবিতা আবৃতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শন থেকে শুরু করে নাচগান সবই থাকে। বর্তমানে কানাডার ১৬টি শহরসহ আমেরিকার ১৮৬টি শহরে এ সংগঠনের আদর্শ মোতাবেক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করা হয়।

সেদিন কোন একটি ইংরেজী পত্রিকার চিঠিপত্র আসরের একটি চিঠি পড়লাম। পত্র লেখক চিঠিতে পরামর্শ চেয়ে লিখেছেন, আসন্ন নববর্ষ উপলক্ষে যে পার্টি তিনি আয়োজন করতে যাচ্ছেন সে পার্টি থেকে অতিথিদের তাড়াতাড়ি বিদায় করার একটি ব্যবস্থাপত্র যেন উত্তরদাতা তাকে দিয়ে কৃতার্থ করেন।

অভিনব চিঠি! একেতো বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করা হচ্ছে তারপর কিভাবে তাড়াতাড়ি বিদেয় করা হবে সে চিন্তা পার্টি আয়োজন করার আগেই! বেশ অদ্ভূত লাগলো। পত্রে আরও লেখা হয়েছে, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে পত্র লেখক দেখেছেন পার্টিতে এসে অনেকে একাধারে সুরা পান করতেই থাকেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত বসে নানান অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করেন। যেটা তার মোটেই পছন্দ নয়।

এবার উত্তর। উত্তরদাতা লিখেছেন- সবচেয়ে ভাল হয় আপনি যদি টেলিফোনে আমন্ত্রণ না জানিয়ে চিঠি লিখে সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। চিঠিতে সুবিধা হলো এই, আপনি সেখানে সময় উল্লেখ করতে পারছেন। যেমন উল্লেখ করে দিন- সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত পার্টিটাইম। এতে অতিথিদের জন্যও সুবিধা হলো তারা এখান থেকে অন্য পার্টিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারবে।

রাত দশটার পর যদি আপনি পার্টি আর কনটিনিউ করতে না চান তাহলে ঘরে কোন পোষা প্রাণী থাকলে সেটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকুন। এতে যদি কাজ না হয় তাহলে সরাসরি বলুন- আপনাকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কোন একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দিতে হবে। জানি অনেকেই বলবে-আর আধঘন্টা…। এরপরও যদি কেউ না উঠে তাহলে আপনার ভাই বা বোনের বিবাহের প্রসঙ্গটি টেনে সবাইকে সে বিয়ের ভিডিও ক্যাসেট দেখার আহ্বান জানান। দেখবেন তরতর করে সবাই উঠে গেছে।

আমার মনে হয় সর্বশেষ ফর্মূলাটাই কার্যকরী। এ ক্যাসেট দেখার ভয়ে অনেকেই বলবে-যাই আমাকে আরেক জায়গায় যেতে হবে। নইলে বলবে-আমারও সকালে কাজ আছে। এ ব্যবস্থাপত্রটি আমাদের সমাজেও কার্যকর হতে পারে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। ভালো হোক, মন্দ হোক, সুখের হোক, আর দুঃখের হোক যে বছর গেছে তাকে যেতে দিন। নতুন বছরটি যেন সুন্দরভাবে কাটে এটাই আমার আপনার সকলের ইচ্ছে।

‘নিশি অবসান, ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত।
আমি আজ ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।’

সবাইকে শুভ নববর্ষ।

Back to top button