সম্পাদকের পাতা

মামলা : আমেরিকান ষ্টাইল

নজরুল মিন্টো

উত্তর আমেরিকার বাসিন্দারা কথায় কথায় একে অন্যকে কোর্টের ভয় দেখায়। আগে ভাবতাম এটা নিছকই কথার কথা। কিন্তু এখন দেখি- না, এগুলো খুবই সত্যি। কারো বাড়ির বারান্দায় কেউ আছাড় খেয়ে পড়লে, কারো পোষা কুকুর বা বেড়াল কাউকে কামড়ালে, গভীররাতে চিৎকার করে কারো ঘুম ভাঙলে ভুক্তভোগি যে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে এবং মিলিয়ন ডলারের মামলা ঠুকে দিতে পারে।

একবার যুক্তরাষ্ট্রের ওলকাহামা রাজ্যে গ্র্যাজিনস্কি নামে এক ব্যক্তি একটি লাক্সারি গাড়ি কিনে ভ্রমণে বেরিয়েছেন। ফ্রি রাস্তা পেয়ে তিনি গাড়ির গতি ৭০ মাইল তুলে ক্রুজে রেখে দেন। এরপর তিনি তার সিট থেকে বের হয়ে পেছনের সিটে বসে কফি বানাতে শুরু করেন। আর ঠিক ঐ মুহুর্তে গাড়ি রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে দুর্ঘটনায় কবলিত হয়।

এরপর গ্র্যাজিনস্কি গাড়ির কোম্পানীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। মামলায় তিনি বলেন, কেন কোম্পানী থেকে তাকে পরামর্শ দেয়া হয়নি যে ফ্রি রাস্তায় ষ্টিয়ারিং ও গতিবেগ স্থীর রাখলেও সিট থেকে সরা যাবে না। তিনি বলেন, হাত দিয়েই যদি কন্ট্রোল করতে হবে তাহলে অটোমেটিক এই সিষ্টেমের কথা বলে গাড়ির দাম এত বেশি রাখা হবে কেন? বিচারক তার রায়ে গ্র্যাজিনস্কিকে আড়াই মিলিয়ন ডলার ও নতুন আরেকটি গাড়ি ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেবার জন্য কোম্পানীকে নির্দেশ দেন। এই ঘটনার পর কোম্পানী তাদের গাড়ির সিষ্টেম পাল্টাতে বাধ্য হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেমন্ট ডেলাওয়ারের এক মহিলা নাম কারা ওয়াল্টন। একবার তিনি একটি নাইটক্লাবে ঢুকতে গেলে দেখেন দরজায় লেখা আছে প্রবেশ মূল্য ৫ ডলার। তিনি এই ৫ ডলার বাঁচাতে ক্লাবের ওয়াশরুম সংলগ্ন জানালা বেয়ে ঢুকতে গিয়ে নীচে পড়ে যান এবং আঘাতে তার কয়েকটি দাঁত নড়বড়ে হয়ে যায়। এ ঘটনায় তিনি নাইটক্লাবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে আদালত তাকে ১৫ হাজার ডলার নগদ এবং চিকিৎসা ব্যয় বহন করার জন্য ক্লাবটিকে নির্দেশ দেয়।

ফিলাডেলফিয়ার একটি রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকে আদালত নির্দেশ দিয়েছিল এম্বার কার্সন নামে এক যুবতী কাষ্টমারকে দেড়লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য। পেনসেলভেনিয়ার এই যুবতী রেষ্টুরেন্টের ফ্লোরে আছাড় খেয়ে হাটুর একটি হাড় ভেঙে ফেলেছিল। ফ্লোরটি পিচ্ছিল ছিল কারণ এ ঘটনার ৩০ সেকেণ্ড আগে সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে কোমল পানীয়ের গ্লাস ছুঁড়ে মেরেছিল।

ব্রিষ্টল পেনসিলভেনিয়ার টেরেন্স ডিকসন নামে এক চোর এক বাড়িতে চুরি করে ফেরার পথে বাসার গ্যারেজে আটকে যায়। সে যখন অত্যাধুনিক গ্যারেজটির দরজা খুলে বাইরে বেরুনোর চেষ্টা করে তখন দরজাটি অটোমেটিক লক হয়ে যায় আর এতে সে গ্যারেজের ভেতরে আটকে পড়ে। বাড়ির মালিক তখন সপরিবারে ভ্যাকেশনে ছিলেন। চোর সেখানে দীর্ঘ ৮ দিন আটকা পড়ে থাকে। ভাগি্যস গ্যারেজে এক কেস পেপসি ছিল। ঐ পেপসি খেয়ে সে জীবন ধারণ করে। সেখানে সে কুকুরের জন্য রাখা কিছু শুকনো খাবারও খায়। পরবর্তীতে ডিকসন ঐ বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। মামলার আর্জিতে বলা হয়, সে এভাবে মরতে গিয়েছিল এবং মানসিকভাবে সে বিপর্যস্ত। মামলায় ডিকসন জয়লাভ করে। আদালত বাড়ির মালিককে ৫০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য নির্দেশ দেয়। অবশ্য বাড়ির মালিককে এ টাকা দিতে হয়নি; দিয়েছে ইন্সুরেন্স কোম্পানী।

সম্প্রতি আলবার্টার ট্রাক ড্রাইবার কেনেথ ডানকানের সাথে তার স্ত্রী বারবারার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পৃথক হয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী বারবারা ভাগ-বাটোয়ারা করে অন্যান্য জিনিষের সাথে তার পোষা কুকুরটিকেও সাথে নিয়ে যায়। কুকুর নিয়ে গেছে ভাল কথা। কিন্তু না, কিছুদিন পর তার মনে হলো- এই কুকুরটির ভরণ পোষনের জন্য সে তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে অর্থ দাবী করবে। দাবী করলেই তো হলো না। কেনেথ বললো- ‘তোমার কুকুর তুমি ইচ্ছে করলে রাখো, না রাখলে কাউকে দিয়ে দাও। যেহেতু তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্কই নেই সেখানে তোমার কুকুর প্রতিপালনের জন্য আমি অর্থ দেবো কেন?’ ব্যাস যায় কোথায়? বারবারা আদালতের শরণাপন্ন হলো।

আদালত দু’পক্ষের বয়ান শুনে কুকুরটির প্রতিপালনের জন্য প্রতি মাসে ২০০ ডলার করে দিতে কেনেথকে নির্দেশ দান করে। এছাড়াও সেন্ট বার্নাড জাতের এই কুকুরটির জন্য তাকে অতিরিক্ত আরও ২ হাজার ডলার দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আলবার্টা আদালতের কুইন্স বেঞ্চের বিচারক ডোনাল্ড লী এই রায় দেন।

কানাডায় এ ধরনের রায় এই প্রথম। ড্রাইভার কেনেথ ডানকানকে এখন তার সাবেক স্ত্রী বারবারার কুকুরের খাওয়া-দাওয়া, স্বাস্থ্য বিল এবং অন্যান্য খরচপাতির জন্য এই অর্থ নিয়মিত দিয়ে যেতে হবে। যদিও ডানকান আদালতে বারবার দাবী করেছিল এই কুকুরের জন্য মাসে মাত্র ২৫ ডলার ব্যয় হয়। আর বারবারা দাবী করেছিলো যে ডানকান যেহেতু বছরে ৪৮ হাজার ডলার আয় করে সেহেতু সে এই অর্থ দেয়া উচিত। বিচারক বলেন, সেন্ট বার্নাড জাতের কুকুরটির রক্ষণাবেক্ষণে নিশ্চয়ই অন্যান্য ছোট জাতের কুকুরের চেয়ে অনেক বেশী খরচ হয়। উল্লেখ্য, এ পরিমান অর্থ ক্যানাডার শিশু রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত আইনে যে ৬৯১ ডলার ব্যায়ভার নির্ধারন করা আছে তার এক তৃতীয়াংশ।

গৃহপালিত পশুর মালিকানা নিয়ে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় এখন আইনি লড়াই বাড়ছে। আইন বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে হুশিয়ার করে দিয়ে বলা হয়েছে, দম্পতিরা যেন পোষা প্রাণীর মালিকানা নিয়ে অবশ্যই একটা চুক্তি প্রণয়ন করে রাখেন।

দেখা যাচ্ছে, আদালত পোষা প্রাণী সম্পর্কে শিশু অধিকারের মতোই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অভিভাবকত্বের রায় দিচ্ছেন। যেসব ক্ষেত্রে দম্পতিরা অধিকার ছাড়তে চাইছেন না সেসব ক্ষেত্রে উভয়ে মাঝে মাঝে প্রাণীটিকে দেখতে যাওয়ার অধিকার পাচ্ছেন।

Back to top button