বড়দিন সমাগত। রঙিন বাতি দিয়ে বাড়িঘর সাজানো হয়েছে নানান রঙে; নানান ঢঙে। যদিও দিনগুলোতে মানুষ খুবই ব্যস্ত তারপরও মুখে হাসি। কাজ থেকে ফিরে ছেলেমেয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটছেন কেনাকাটা করতে। যারা সময় পাচ্ছেন না তারা বেছে নিয়েছেন উইকএন্ড।
এ বিশেষ দিনটিকে কেন্দ্র করে সারা দেশের বিপনী বিতানগুলো গত এক মাস ধরে নানান সাজে সজ্জিত হয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রতি বছরই এরকম হয়। এ সময়টাতে কোন একটি শপিং সেন্টারের ভেতরে ঢুকলে বুঝা যায় বড়দিন বা ক্রিসমাসের প্রস্তুতি কেমন। কেনা-কাটা কত প্রকার এবং কি কি। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। একবার শপিং সেন্টারে যাওয়া আর আসার মধ্যেই দিন শেষ। যেমন ভিড় দোকানে তেমন ভিড় পার্কিং লট-এ। রেডিও-টেলিভিশন, পত্র-পত্রিকায় ক্রিসমাস নিয়ে নানান ধরনের আলোচনা, লেখালেখি, বিজ্ঞাপন-বিজ্ঞপ্তির ঢেউ উঠেছে। এক কথায় ক্রিসমাসকে কেন্দ্র করে সারা দেশজুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ।
এ উৎসবের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে প্রিয়জনের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান। শপিং সেন্টারের ভিড়-বাট্টা এই উপহার কেনা-কাটাকে কেন্দ্র করেই। কেনাকাটার উৎসাহ দেখে মনে হয় একেকজন পকেট উজাড় করে দিচ্ছে। ক্রিসমাস উপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দিয়েছে মূল্যহ্রাস। প্রতিটি শপিং সেন্টারে একজন করে সান্তাক্লজ রাখা হয়েছে লাইন ধরে যার সাথে ছবি তুলে শিশুরা এবং তারা কি উপহার চায় তা সান্তাকে কানে কানে বলে আসে।
গত কিছুদিন পোষ্ট অফিস এবং কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর ব্যস্ততা দেখে কে! শুভেচ্ছা কার্ড আর পার্সেলের বহর নিয়ে নাকি ক্রিসমাসের আগের দিন পর্যন্ত তাদের এই ব্যস্ততা থাকবে। সারা বছর হয়তো কারো সাথে কারো দেখা নেই, কথা নেই, যোগাযোগ নেই কিন্তু ক্রিসমাসের সময় কার্ড পাঠাতে ভুল হয় না। এই একটি মাত্র সময় এখানকার মানুষ প্রিয়জনকে স্মরণ করতে ভুলে না। শুধু প্রিয়জন বলে কথা নয়; যাদের অর্থ সম্পদ আছে তারা গরীবদেরও স্মরণ করেন। গরীব ছেলেমেদের খুশী করতে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে তারা মোটা অংকের অর্থ সাহায্য প্রদান করেন।
দৈনিক টরন্টো ষ্টার পত্রিকা প্রতি বছর ক্রিসমাস উপলক্ষে তহবিল সংগ্রহ করে গরীব শিশুদের উপহার প্রদান করে। উত্তর আমেরিকায় এরকম বেশ কিছু সংগঠন রয়েছে যারা প্রতিবছর দুঃস্থ শিশুদের মুখে হাসি ফোটাতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সলভেশন আর্মি এদের মধ্যে অন্যতম। বরাবরের মতো এবারও তাদের কর্মীদের দেখা যায় বিভিন্ন সাবওয়ে, ইন্টারসেকশনে দাঁড়িয়ে তহবিল সংগ্রহ করতে। এ অর্থ দ্বারা তারা উপহার সামগ্রী ক্রয় করে ভাগ্যবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছে দেয়। উল্লেখ্য কানাডায় বসবাসকারী প্রতি ছয়জন শিশুর একজন দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে।
অতিসম্প্রতি এক জরীপে দেখা গেছে, এবারকার বড়দিনকে উপলক্ষ করে গড়ে প্রতি ক্যানাডিয়ান ৫৭৫ ডলারের উপহার সামগ্রী কিনছে। সবচে’ বেশি খরচ করছে আটলান্টিক কানাডার লোকেরা। তারা গড়ে খরচ করছে ৭২৮ ডলার আর সবচে’ কম খরচ করছে কুইবেক-এর লোকেরা; তাদের গড় খরচ ৩৯৭ ডলার। এবারকার উপহার সামগ্রীর মধ্যে সবচে’ বেশি বিক্রি হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স জিনিষপত্র। জরীপে দেখা যায় মহিলাদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ পোষাক-আষাক এবং ১৭ ভাগ জুয়েলারী কিনছে। পুরুষদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ লোক বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি কেনার প্রতি ঝোঁক বেশি।
ক্রিসমাসের গাছ বিক্রি করে কোটিপতি বনে গেছ কুইবেকের গিটবার্ট ভ্রাতৃত্রয়। এ বছর তারা ৬.৭ মিলিয়ন ডলারের গাছ বিক্রি করেছে। কানাডিয়ান টাওয়ার, হোম ডিপোসহ ৫০টি কোম্পানীর কাছে তারা গাছ বিক্রি করে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯ শতকের আগে উত্তর আমেরিকায় এই ক্রিসমাস ট্রি’র কোন প্রচলন ছিল না। ক্রিসমাস ট্রি’র ধারণাটা এসেছে জার্মানী থেকে। ষোড়শ শতাব্দীতে জার্মানরা ক্রিসমাসের দিন এই ক্রিসমাস ট্রি’র ডালে ফুল এবং ফল দিয়ে সাজিয়ে রাখতো। আটলান্টিকের এ পারে ক্রিসমাস ট্রি’র প্রচলন শুরু হয় মাত্র দুই’শ বছর আগে। ক্রিসমাস ট্রিতে লাইট জ্বালানোর ধারণাটা আসে ধর্মীয় নেতা মার্টিন লুথারের কাছ থেকে। যদিও নিছক সুন্দরের জন্য প্রথম প্রথম লাইট জ্বালানো হতো বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের শোভা বর্ধনকারী জিনিষ দিয়ে সাজানো হয় এবং প্রত্যেকটি জিনিষের বিভিন্ন অর্থও রয়েছে।
ক্রিসমাসের আরেকটি প্রতীক সকলেই জানেন সেটা হচ্ছে বেতে লাঠির মতো পিপারমিন্ট ক্যান্ডি। ঊনিশ শতক থেকে প্রচলিত এ লাঠির আবিষ্কারকে কে বা কারা তা খুঁজে না পাওয়া গেলেও ক্রিসমাসের সাথে এর সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। ক্যান্ডি লাঠিটাকে উল্টিয়ে ধরলে ইংরেজী অক্ষর ‘জে’ দেখা যায়। ‘জে’ মাসে জিসাস অর্থাৎ যিশুখৃষ্ট। লাঠির মধ্যে সাদা আর লালের আস্তরণ-এর অর্থ যিশুখৃষ্টের পবিত্রতা এবং রক্তপাতের চিহ্ণ।’
ক্রিসমাসের আনন্দ ছোটদের মধ্যে বেশি। তাদের আনন্দে বড়রাও আনন্দিত হন। সারা পরিবার জুড়ে আনন্দের উৎস তারাই। সারাবছর এদিনটির অপেক্ষায় থাকে শিশুরা। আর তাদের কাছে এ দিনের প্রধান আকর্ষণ যে ব্যক্তি তিনি বাবা-মা কেউ নন; তিনি হচ্ছেন সান্তাক্লজ।
সান্তাক্লজ নিয়ে নানা কাহিনী আছে। অনেকে বলেন, আসল সান্তাক্লজের জন্ম তুরস্কে। তার নাম সেন্ট নিকোলাস। চতুর্থ শতাব্দীতে গরীবদের ত্রাতা হিসেবে তিনি আবির্ভুত হন এবং এ কারণে রোমানদের দ্বারা তাঁকে অনেক যাতনা সইতে হয়েছে। হল্যান্ডের শিশুরা তাদের বাবা-মার কাছ থেকে নিকোলাসের গল্প শুনতো। গল্প শুনে শুনেই কিংবদন্তীর নায়ক হয়ে যান নিকোলাস। ডাচরা তাঁকে ডাকতো সিন্তারক্লাস নামে। এই সিন্তারক্লাসই সান্তাক্লজ। আধুনিক সান্তাক্লজের যে রূপ তা এসেছে ক্লেমেন্ট মুর-এর অমর কবিতা ‘এ ভিজিট ফ্রম সেন্ট নিক’ থেকে। ১৮২২ সালে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে কবিতাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘দ্য নাইট বিফোর ক্রিসমাস’।
ক্রিসমাসের আনন্দের সময় বিষাদের ঘটনাও ঘটে প্রচুর। চুরি-ডাকাতিও বেড়ে যায়। মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে। টরন্টো পুলিশ সম্প্রতি মাতাল ড্রাইভারদের ছবি ওয়েবসাইটে দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এখন থেকে কাউকে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় ধরতে পারলে পয়েন্ট তো যাবেই সেই সাথে প্রচারের দায়িত্বটাও পুলিশ পালন করবে।
ইতিমধ্যে অঘটন ঘটতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহে এক লোক হলিউডের এক ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংক টেলারকে মেরি ক্রিসমাস জানিয়ে একটি চিরকুট দেয়। চিরকুটে লেখা-‘আমি একজন ডাকাত তোমার কাছে যত টাকা আছে বিনা শব্দে আমার হাতে তুলে দাও; সময় মাত্র ২০ সেকেন্ড। ব্যাংক টেলার সব টাকা তার হাতে তুলে দিলে সেও নিঃশব্দে হেঁটে চলে যায়। বিনা অস্ত্রে ডাকাতির রেকর্ড!
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পেয়সন শহরে একটি ক্রিসমাস উপহার নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটে গেছে। খবরে প্রকাশ, জুডি লি নামে এক মহিলা ক্রিসমাসের উপহার কিনে একটি কালো রঙের গার্বেজ ব্যাগে ভরে এটা দরজার কাছে রাখে। উপহারটি একটি পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে দেবার কথা। গত শুক্রবার মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাকটি যখন বাড়ির সামনে আসে তখন অন্যান্য আবর্জনা ব্যাগের সাথে এটাও নিয়ে যায়। গাড়ি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় হৈ চৈ। জুডি লি উপায়ন্তর না দেখে মিউনিসিপালিটিতে ফোন করে ঘটনাটি জানান। কর্মকর্তারা সাথে সাথে ঐ ট্রাক ড্রাইভারকে তথ্য দেয় যে ‘গাড়ি যেখানে যে অবস্থায় আছে সেখানে থামাও’। তারপর খুঁজে বের করা হয় সেই ব্যাগটি যেখানে ৩০০ ডলার দিয়ে কেনা উপহার বাক্সটি সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। উপহার বাক্সের মধ্যে ছিল একটি ফ্রক, দুই জোড়া পেন্ট, চারটি শার্ট এবং দুটো সোয়েটার।
জুডি লি ধন্যবাদ জানান ঈশ্বরকে। ধন্যবাদ দেন মিউনিসিপালিটির কর্মকর্তাদের যাদের জন্য ছোট্ট মেয়েটি ক্রিসমাসের আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। এ উপহারটি তার নিজের কোন মেয়ের জন্য নয়; এটা ছিল মাতৃহারা একটি প্রতিবেশী মেয়ের জন্য। যার বাবাও দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন। প্রতি বছর লি দম্পতি ভাগ্যবঞ্চিত শিশু এবং দুঃস্থ পরিবারকে ক্রিসমাসের উপহার দিয়ে আসছেন। যদিও গত বছর থেকে তার চাকুরী নেই; অভাব অনটনে আছেন তারপরও ঐ মেয়েটির মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অনেক কষ্টে জমানো টাকা থেকে তিনি তিনশত ডলার ব্যয় করেন।
মানুষ মানুষের জন্য। বড় দিনের শুভেচ্ছা সকলকে। হাসি আর আনন্দে ভরে উঠুক ছুটির দিনগুলো।