ইউরোপ-আমেরিকার কিছু কিছু বিষয় বড়ই অদ্ভূত লাগে। অনেকেই খেয়াল করেছেন হয়তো যে, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আমরা যখন ঠান্ডা পানি খুঁজি তখন এসব দেশের লোকজন মগ ভরে চা/কফি পান করছে। আবার কনকনে শীতের দিনে আমরা যখন চা/কফি পান করে শরীরকে গরম রাখতে চেষ্টা করি তখন এরা বাইরে বরফের স্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খায়।
প্রথম প্রথম এসব বিষয় আজব মনে হলেও এখন আর আজব লাগে না। মাঝে-মধ্যে ভাবি এখানকার শহরগুলোতে আমাদের দেশের মতো চায়ের দোকান নেই কেনো? কফির দোকানে কেন চা বিক্রি হয়? চায়ের দোকানে কেন কফি বিক্রি হয় না? নিজেই উত্তর খুঁজে নিই। আমরা যেটাকে উল্টা বলি সেটাই এখানকার পাল্টা। আর এই উল্টা-পাল্টাতেই তারা মজা খুঁজে বেড়ায়।
কফি তৈরিতে কাজ বেশি। তৈরি করতে মুনশিয়ানা বা কারিশমা লাগে। তাইতো ষ্টারবাকসের কফির স্বাদ টিম হর্টন বা সেকেন্ড কাপের সাথে মিলে না। ফ্লেভার আলাদা, ষ্টাইলে পার্থক্য, দামেও পার্থক্য আছে। অন্যদিকে চা বানাতে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লাগে না। গরম পানির মধ্যে একটা টি ব্যাগ ঝুলে দিলেই চা হয়ে যায়। এবার দুধ চিনি নিজে নিজেই মিশিয়ে নিন। আর চা তৈরিতে কিছু লাগে না বলেই বোধ হয় কফির দোকানে চা বিক্রি হয়।
অবশ্য, এখানকার চাইনিজ রেষ্টুরেন্টগুলোতে চা আছে তবে তা খাবারের আগে বা পরে তাদের মতো করে তারা পরিবেশন করে। ভারতীয় রেষ্টুরেন্টগুলোতেও চা আছে- লোকজন খাবারের পরে চা পান করে। এমনিতে কেউ চা পান করতে হলে কফির দোকানেই যেতে হবে।
একদিন বড় এক শপিং সেন্টারে একটি চায়ের দোকান আবিষ্কার করলাম। না, এ চায়ের দোকানে লোক চা পান করতে যায় না। চা-পাতা কিনতে যায়। এখানকার ক্রেতারাও বিশেষ ক্রেতা। সৌখিন ক্রেতা। দোকানে ঢুকলে একটা স্বর্গীয় সুগন্ধির আবেশে মন জুড়িয়ে যায়। দোকানের নাম- ডেভিড’স টি।
এখানে এলে আপনি জানতে পারবেন পৃথিবীতে চা কত প্রকার এবং কি কি। নানান ধরনের চাপাতা, নানান বর্ণের, নানান গন্ধের, নানান দেশের। প্যাকেটজাত নয় একেবারে খোলা চাপাতা। আপনি যদি এর স্বাদ নিতে চান নমুনা হিসেবে আপনাকে তাৎক্ষণিকভাবে তারা ছোট্ট একটি কাপে পরিবেশন করবে।
দাম শুনলে আৎকে উঠতে পারেন। কেবল এটুকুই বলবো যে জুয়েলারি দোকানে স্বর্ণ যেভাবে গ্রাম হিসেবে বিক্রি হয় এখানে চাপাতাও বিক্রি হয় গ্রাম হিসেবে। এখানকার এক গ্রাম চায়ের দামে চাইনিজ সুপার মার্কেটে ১০০ ব্যাগের বড় চায়ের প্যাকেট কিনতে পারবেন। “David’s Tea” কানাডারই প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষায়িত চায়ের ব্র্যান্ড যা এখন ইউএসএ-তেও বিস্তৃত। এই দোকানের সংস্পর্শে আসার পর থেকেই অন্য কোন দোকানের চায়ে আমার আর মন ভরে না। ‘উলং টি’ আমার প্রিয় চা।
এতোদিন মনে করতাম বাঙালিরা কেবল সংগঠন করে। রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, জেলা সংগঠন, ইউনিয়ন সংগঠন, নারী সংগঠন কত কি! কিন্তু এখন দেখি- না, ভুল মনে করতাম।
বাঙালিদের চেয়েও সংগঠন প্রিয় জাতির অভাব নেই পৃথিবীতে। বাঙালিদের যতই সংগঠন প্রিয় জাতি হিসেবে তকমা লাগানো হোক না কে চা/কফির মতো কোন সংগঠন এখন পর্যন্ত কোথাও কোন বাঙালি করতে শুনিনি। কানাডাতে এসে দেখলাম চা/কফি পানকারীদেরও সংগঠন আছে। অবাক করা কান্ড!
একটি সংগঠনের নাম ‘টি এন্ড কফি অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা’, অন্যটির নাম ‘টি কাউন্সিল অব কানাডা’। দু’টোর মধ্যে আবার মতানৈক্যও প্রচন্ড। প্রথম সংগঠন বলতে চাচ্ছে কানাডাতে কফি পানকারী লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী। ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ লোক কফি পান করে থাকে। অন্য সংগঠন বলছে না, শুধু মাত্র অফিস চলাকালীন সময়ে মানুষ কফি পান করে থাকে কিন্তু ঘরে ফিরে এসে সবাই চা পান করে।
প্রথম সংগঠন এক জরিপ চালিয়ে তথ্য প্রকাশ করে যে, কফি পানকারীরা গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে সোয়া তিন কাপ কফি পান করে থাকে।
অন্য সংগঠন বলছে- এ জরিপে ভুলও হতে পারে। তারা বলছে কফির চাইতে চা পানকারীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে লাঞ্চের পর বিনা মূল্যে চা দেওয়া হয়। এছাড়া সব রেষ্টুরেন্টেই চা থাকে। তারা আরও বলে- চা পান করে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় অন্য কোন পানীয় সে তৃপ্তি দিতে পারে না।
কফি সংক্রান্ত তথ্য:
- কানাডিয়ানরা প্রতিবছর গড়ে ১৫ কেজি কফি গ্রহণ করে থাকে, যা বিশ্বে শীর্ষ ১০-এ পড়ে।
- কানাডার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি ব্র্যান্ড: Tim Hortons (টিম হর্টনস), Starbucks, McCafe।
- ১৮ থেকে ৭৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ৭১% লোক নিয়মিত কফি পান করে।
- দুবাইয়ের এক হোটেলে ‘সোনার পাতা’যুক্ত কফি পরিবেশন করা হয়—এক কাপের দাম ৭৫ ডলার! এই কফির উপর সোনার পাতা ভাসানো থাকে, যার কোনও পুষ্টিগুণ নেই, শুধু সৌন্দর্য ও বিলাসিতার জন্য।
- অনেকে শুধু ইনস্টাগ্রাম পোস্টের জন্য এটি কিনে খায়!
চা-সংক্রান্ত তথ্য:
- বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বাধিক পানীয় হচ্ছে চা (প্রথম পানি)।
- চা-এর স্বাস্থ্যগুণ যেমন: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, হজমে সহায়তা, মন প্রশান্ত করা ইত্যাদি।
- গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি, উলং টি, হোয়াইট টি– এগুলোর মধ্যে গ্রিন ও উলং টি বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতনদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়।
- কানাডাতে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে চা পানীয় হিসেবে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯০ সালের দিকে মানুষ যখন স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে পড়ে তখন এর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়।
- মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ‘নীলকণ্ঠ টি কেবিন’ নামে এক চায়ের দোকানে পাওয়া যায় সাত রঙের চা—একই কাপের ভেতরে সাতটি আলাদা স্বাদের স্তর! চায়ের উপর রংবেরঙের স্তরগুলো যেন কাঁচের গ্লাসে আঁকা এক শিল্পকর্ম। অনেকে শুধু ছবি তোলার জন্যই এই চা অর্ডার করে। এই চায়ের খ্যাতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপ-আমেরিকাতেও। BBC, CNN, The Guardian—বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে এই চায়ের কথা।
বি. দ্র.:
আপনি যখন কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, অন্য কোন পানীয় নয়, এক কাপ চা পান করুন। এতে মনের সতেজতা বৃদ্ধি পাবে। কাজ করতে আনন্দ পাবেন। মনে রাখবেন দুধ চিনি ছাড়া চা পান স্বাস্থ্যসম্মত। চা খেলে ঘুম হয় না এটা ঠিক নয়। আমার মতো অনেকেই আছেন যাদের চায়ের কাপে ঠোঁট লাগা মাত্র দু’চোখ ঘুমে বুজে আসে।