জাতীয়

টিকা না দিলেও কোন দায় নেই সেরামের

ঢাকা, ০৭ মে – ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে করা বাংলাদেশ সরকার ও বেক্সিমকোর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী টিকা না আসার এই পরিস্থিতির জন্য কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই।

কেননা চুক্তিতে বলা আছে, কোনো পক্ষ যদি পরোক্ষ বা বিশেষভাবে কিংবা বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে কেউ দায়ী থাকবে না। পক্ষগুলোর মধ্যে আছে সরকার, বেক্সিমকো ফার্মা ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট।

তিন পক্ষের মধ্যে টিকা কেনার এই চুক্তি হয়েছিল গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর। ২৭ পৃষ্ঠার চুক্তিতে টিকার দাম, সরবরাহব্যবস্থা, দায়দায়িত্ব, সেবা ফি, অপ্রতিরোধ্য কারণ (ফোর্স মেজর) বিষয়ে বলা আছে। তাতে বলা হয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা বাংলাদেশের কাছে বিক্রি করবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মা এই টিকার পরিবেশকের দায়িত্ব পালন করবে।

চুক্তির আওতায় এ পর্যন্ত ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৭১৯ জন প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৫ মের পর আর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মতো টিকা থাকবে না। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির কর্মকর্তারা এ নিয়ে জানিয়েছেন, প্রথম ডোজ পাওয়া প্রত্যেককে দ্বিতীয় ডোজ টিকা তাঁরা দিতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা কম।

ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে সরকারের পক্ষে সই করেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, বেক্সিমকো ফার্মার পক্ষে প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এস এম রাব্বুর রেজা এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক (রপ্তানি) সন্দীপ মুলে। বিভিন্ন গনমাধ্যম থেকে তিনজনের সঙ্গে লিখিতভাবে ও মুঠোফোনে চুক্তির বিষয় ও টিকার পরবর্তী চালান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়। কেউ লিখিতভাবে উত্তরও দেননি, ফোনও ধরেননি।

তবে যোগাযোগ করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই চুক্তিতে কী আছে, আমি জানি না। আমি কোনো দিন ওই চুক্তি দেখিনি।’

টিকা পাওয়ার সময়সীমা

চুক্তিতে আছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এই টিকা বাংলাদেশে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই টিকা রপ্তানি শুরু করবে সেরাম ইনস্টিটিউট। টিকা রপ্তানি শুরু করার পর থেকে ছয় মাসের মধ্যে মোট ৩ কোটি টিকা তারা বাংলাদেশে পাঠাবে। প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন কত টিকা দেবে, তা তিন পক্ষ আলোচনা করে ঠিক করবে। তবে ছয় মাসেই চুক্তির ৩ কোটি টিকা বাংলাদেশে পাঠাবে, তা স্পষ্ট বলা আছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেরামের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় জানুয়ারি মাসে। এরপর টিকার প্রথম চালান আসে ২৫ জানুয়ারি। প্রথম চালানে ৫০ লাখ টিকা এসেছিল। তখন বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এরপর প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে টিকা আসবে। ফেব্রুয়ারি মাসে সেরাম ২০ লাখ টিকা পাঠিয়েছিল। মার্চ ও এপ্রিল মাসে কোনো টিকা পাঠায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, এই মুহূর্তে সরকার চুক্তির খুঁটিনাটি বিষয়ের চেয়ে বাকি টিকা পাওয়ার বিষয়টিতে জোর দিচ্ছে। এ জন্য গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ত্রিপক্ষীয় চুক্তির চালান থেকে ৩০ লাখ টিকা সরবরাহের জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে চিঠি পাঠিয়েছেন। রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার যে প্রক্রিয়া চলছে, সেখানে সেরামের চুক্তির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

টিকার দাম

চুক্তিতে বলা আছে, বাংলাদেশ ৩ কোটি টিকা কিনবে ১২ কোটি ডলার বা ১ হাজার ২০ কোটি টাকা দিয়ে। অর্থাৎ প্রতিটি টিকার দাম ৪ ডলার। তবে সেরাম ইনস্টিটিউট যদি এর চেয়ে কম দামে ভারত সরকারকে টিকা সরবরাহ করে, তাহলে সেই দামের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশের জন্যও দাম কমানো হবে। ভারত থেকে টিকা আসার আগেই চুক্তি অনুযায়ী ৬ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে সরকার।

এ ছাড়া প্রতি ডোজ টিকা পরিবেশন করার জন্য বেক্সিমকো সরকারের কাছ থেকে এক ডলার করে পাচ্ছে। অর্থাৎ বেক্সিমকো সেরামের টিকা সরকারের হাতে তুলে দিয়ে ১৭৪ কোটি টাকা পাবে। এটাকে চুক্তিতে ‘সার্ভিস ফি’ বলা হয়েছে।

অবশ্য এ ক্ষেত্রে বেক্সিমকোর কিছু দায়দায়িত্বের কথাও বলা আছে। যেমন সেরামের কাছ থেকে টিকা নিয়ে কোল্ড চেইন বজায় রেখে বেক্সিমকো দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে সরকারের গুদামে টিকা পৌঁছে দেবে।

সেরাম থেকে কেনা টিকা পরিমাণে কম থাকলে, নষ্ট হলে, কম পড়লে বা কোনো ধরনের ত্রুটি থাকলে সরকারি গুদামে দেওয়ার আগে তা দেখার দায়িত্ব বেক্সিমকোর। সেরামের সহযোগিতায় টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করার দায়িত্বও বেক্সিমকোর। টিকা সংরক্ষণ ও পরিবহন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেবে বেক্সিমকো—এমন কথাও চুক্তিতে বলা আছে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে এ–সংক্রান্ত তথ্য ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) জানাতে হয়েছে। দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-মার্চ সময়ে কোম্পানিটি সরকারকে ৫০ লাখ করোনার টিকা সরবরাহ করে সব খরচ বাদ দেওয়ার পর ৩৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে।

বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন সামগ্রিক দিক নিয়ে বলেন, ‘টিকা আনার বিষয়টি এখন পুরোপুরি ভারত সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। মার্চ মাসের চালানের জন্য সেরামের কাছে চাহিদা দেওয়া আছে। সরকার অনুমোদন না দিলে সেরাম সেই টিকা পাঠাতে পারবে না। আর আমরা ভারত থেকে টিকা এনে সরকারকে সরবরাহের কাজটি করছি। তাই ওই দিক থেকে টিকা না পেলে আমাদের কিছু করার নেই। আবার সেরামেরও যে কিছু করার আছে, সেটিও না। সরকারিভাবে আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, চুক্তিতে অনেক ঝুঁকির কথা বলা আছে, যা বেক্সিমকো একাই বহন করছে। সে বিষয়গুলো আলোচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

দায়মুক্তি ও অপ্রতিরোধ্য কারণ

চুক্তির ১২ ধারায় বিভিন্ন পক্ষের দায়দায়িত্বের বিষয়ে বলা আছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, এই চুক্তির অন্যত্র ভিন্ন কিছু বলা না থাকলে, কোনো পক্ষ যদি পরোক্ষ বা বিশেষভাবে কিংবা বিশেষ কোনো পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে কেউ দায়ী থাকবে না।

১৩ ধারায় কিছু অপ্রতিরোধ্য কারণের (ফোর্স মেজর) কথা উল্লেখ আছে। অপ্রতিরোধ্য কারণের মধ্যে সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধও (রেস্ট্রিকশনস অব গভর্নমেন্ট) আছে। যার অর্থ এই যে ভারত সরকার বাধা দিলে সেরাম চুক্তি অনুযায়ী টিকা রপ্তানি করতে পারবে না।

তবে চুক্তিতে এ–ও বলা আছে, এ ধরনের অপ্রতিরোধ্য কারণে যদি চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, তা হলে প্রত্যেক পক্ষ বিকল্প উপায়ে কাজটি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। আরও বলা আছে, কেউ যদি ওই অপ্রতিরোধ্য কারণে দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তা হলে তা অবিলম্বে অন্য পক্ষকে নোটিশ দিয়ে জানাতে হবে এবং বিলম্বটা কত দিনের হবে, তা–ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, এই পরিস্থিতির জন্য সবাই দায়ী। যারা টিকা আনার চুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল, যারা টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা করেছিল। সবচেয়ে বড় ভুল ছিল টিকার ব্যাপারে একটি উৎসের ওপর নির্ভর করা।

সূত্র : নতুন সময়
এন এইচ, ০৭ মে

Back to top button