সিলেট

‘ঝাল’ মিটিয়ে বেধড়ক পেটানোই রায়হান হত্যার কারণ!

সজল ছত্রী

সিলেট, ০৬ মে– অপরাধ জোন হিসেবে পরিচিত কাস্টঘরে রায়হান আহমেদ কেন গিয়েছিলেন- সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। তবে জানা গেল, জনৈক ব্যক্তির সরবরাহ করা নকল ইয়াবার অর্থ ফেরত বিষয়ে ঝগড়ায় সরবরাহকারীর পক্ষ নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে পুলিশ বলেও পরিচয় দেন। সেখান থেকে প্রতারিত সাইদুল শেখ যোগাযোগ করেন আসল পুলিশের সঙ্গে। পুলিশ সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হলে তাদের সঙ্গেও ধস্তাধস্তি হয় রায়হানের। তার পর আটক করে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে এনে ঝাল মিটিয়ে বেধড়ক পেটানোকেই আপাতত রায়হান হত্যার কারণ বলে প্রমাণ করতে চাইছে পুলিশ। সিলেটে গত বছরের ১১ অক্টোবর ওই যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে দেওয়া অভিযোগপত্রে এমন ইঙ্গিতই করেছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

রায়হানের পরিবার অবশ্য এই চার্জশিটে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) সৌমেন মৈত্র বারবার ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা এবং পুলিশ ফাঁড়ি থেকে ফোন দেওয়া তৌহিদকে অভিযুক্ত না করা ও পলাতক সাংবাদিক নোমানকে গ্রেপ্তারে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়েই উল্টো হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহতের মা সালামা বেগম। প্রায় সাত মাস পর দেওয়া এ প্রতিবেদনে নারাজি দেবেন কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেব।’

প্রতিবেদন দাখিলের পর পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির সিলেট বিভাগীয় সুপার হুমায়ুন কবির ও পিবিআই সিলেটের সুপার খালেদ-উজ জামান যদিও দাবি করেন, অত্যন্ত নিবিড়ভাবে প্রায় ৬৯ সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে নির্যাতন এবং দুজনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে আলামত ধ্বংসের অভিযোগ। ছয় আসামির পাঁচ পুলিশ সদস্যের সবাই গ্রেপ্তার আছেন। পলাতক সাংবাদিক নোমানকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আসামিদের মৃত্যুদ- হতে পারে এমন ধারা মামলায় যুক্ত করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে করা হয়েছে প্রধান অভিযুক্ত। অন্য অভিযুক্তরা হলেন- ওই পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি ও হাসান উদ্দিন, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস এবং সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমান। এর মধ্যে নোমানের বিরুদ্ধে এসআই আকবরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা ও রায়হানকে নির্যাতনের আলামত ধ্বংসের অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে সিলেটের আলোচিত এই হত্যা মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করে পিবিআই। প্রসিকিউশন শাখা তা ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে পিবিআই পুলিশ সুপার খালেদ-উজ জামান বলেন, ‘অভিযোগপত্রভুক্ত ছয়জনের মধ্যে পাঁচ পুলিশ সদস্যই কারাগারে আছেন। তবে নোমান পলাতক। এ ঘটনায় তৌহিদ মিয়া নামে আরেক পুলিশ কনস্টেবল গ্রেপ্তার হলেও সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি।’

নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এসআই (ইনচার্জ) আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এর পর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করেন রায়হান। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। ফজরের নামাজের আগ মুহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন রায়হানের সেই স্বজন। কিন্তু তাকে রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। সকালে আবার তিনি ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতপালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে তার মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

এ ঘটনায় ১১ অক্টাবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাত মাস পর চাঞ্চল্যকর সেই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিল পিবিআই। চার্জশিটে যেসব আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ-ও হতে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশের বিশেষ এই সংস্থাটি। এসপি খালেদ-উজ জামান বলেন, ‘অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে ৩০২, ৫০১ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর ১৫(২), ১৫(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দুই আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- এবং অপরটিতে যাবজ্জীবনের কথা উল্লেখ আছে। ফলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মৃত্যুদ-ও হতে পারে।’

১৯৬২ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে এসপি বলেন, ‘এর মধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যাদের মধ্যে সাতজনই পুলিশ সদস্য।’ তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্বপরিকল্পিত কিংবা পূর্ববিরোধের জের ধরে নয় বলে দাবি পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার। তিনি বলেন, ‘তদন্তে রায়হান আহমদকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানোর প্রমাণ মিলেছে। ওই পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ বহিষ্কৃত এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, বহিষ্কৃত এএসআই আশেকে এলাহি, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহয়াতা করেন বহিষ্কৃত এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল নোমান। অভিযোগপত্রে এ ছয়জনকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে।’

ফাঁড়িতে রায়হানকে ধরে আনা প্রসঙ্গে এসপি খালেদ-উজ জামান বলেন, ‘সাইদুল শেখ নামে এক ব্যক্তির করা ছিনতাইয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ। সাইদুল মূলত ইয়াবা সংগ্রহ করতে কাষ্টঘর এলাকায় গিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলাও রয়েছে। ওই সাইদুলের দাবি- ইয়াবা সংগ্রহকালে সেখানে রায়হানের সঙ্গে তার বাগ্বিত-া হয়। তার অভিযোগ পেয়েই রায়হানকে কাষ্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদকালে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে মারা যান।’

রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, অন্য কারও ইন্ধনে পূর্বপরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেছে পুলিশ। চার্জশিট দেওয়ার পর সালমা বেগম বলেন, ‘ইয়াবা-ছিনতাইসহ এখন নানা বিষয়ে রায়হানকে জড়ানো হচ্ছে। আমার ছেলে যেহেতু বেঁচে নেই, তাই এমন বিষয়ের সত্য-মিথ্যা যাছাই করাও সম্ভব না। এখন তো সে আর এসবের প্রতিবাদও করতে পারবে না। ফলে আমাদের দাবি একটিই- রায়হান হত্যার বিচার চাই।’ তবে বুধবার এসপি খালেদ-উজ জামান বলেন, ‘দীর্ঘ তদন্ত, সবার সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রায়হান ও আকবরসহ সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোনালাপ সংগ্রহ করেও আমরা এ রকম কোনো প্রমাণ পাইনি। রায়হানকে নির্যাতনের সঙ্গে পূর্ববিরোধের কিছুই পাওয়া যায়নি।’

এম এন / ০৬ মে

 

Back to top button