জাতীয়

স্বাস্থ্যের সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকাই অব্যবহৃত

আবু হেনা মুহিব

ঢাকা, ২৮ এপ্রিল – দেশে করোনার চিকিৎসা সুবিধা পর্যাপ্ত নয়। অথচ করোনাসহ অন্যান্য চিকিৎসায় বরাদ্দের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা পড়ে আছে অব্যবহৃত। চিকিৎসায় বিদেশি সহায়তার অর্থও খরচ হচ্ছে না। সরকারি বরাদ্দ থেকেও খরচ হয়েছে নামকাওয়াস্তে। উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতার অভাবেই এ অবস্থা হয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। করোনার বাস্তবতা বিবেচনায় আরও বেশি বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল বলে তখন বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বলা হয়। সে সময় এক সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, অর্থ কোনো সমস্যা নয়। বাস্তবায়নই প্রধান সমস্যা। মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করতে পারলে আরও অর্থ দিতে প্রস্তুত রয়েছে সরকার।

করোনাকালে অগ্রাধিকার বিবেচনায় চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থই ছাড় করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। এটার হার ৯৫ শতাংশ। অথচ বৃহৎ বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নে সবচেয়ে পেছনে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়নের দিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অবস্থান ৩৮তম।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত গত ৯ মাসে করোনা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন এডিপি বাস্তবায়নে এই বিভাগ মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় করতে সক্ষম হয়েছে। বৃহৎ বরাদ্দপ্রাপ্ত এই ১৫ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন গড়ে ৪২ শতাংশেরও বেশি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদন থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য খাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে এই করুণ অবস্থার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা অনু বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, অনেক প্রকল্পের প্রধানই হচ্ছেন চিকিৎসকরা। তারা ভালো চিকিৎসা জানেন; কিন্তু ভালো ব্যবস্থাপনা বোঝেন না। এ কারণে প্রকল্পের কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী সব সময় আগায় না। কিছু দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রকল্পের পরিচালককে সরিয়ে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের পূর্ত কাজে গণপূর্ত বিভাগ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, করোনাকালে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়ার পরও বাস্তবায়ন কম হওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে, টিকা সংগ্রহে বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বড় অঙ্কের দুটি ঋণ প্রকল্প। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থের পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা। এডিবির পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা। টিকা সংগ্রহ হলে এ অর্থ ব্যয় হবে। তখন বাস্তবায়নের হার অনেক বেড়ে যাবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অগ্রাধিকারভিত্তিক বরাদ্দ মানসম্পন্নভাবে ব্যয় করা সম্ভব হলে করোনার চলমান দ্বিতীয় ঢেউ এতটা মারাত্মক আকার নিত না। কারণ, বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে আইসোলেশন ইউনিট করার জন্য, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। এগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলেই গোটা জাতিকে এখন এতটা খেসারত দিতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় সক্ষমতা দুটোই কম। তার পরও করোনার ভয়াবহ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে কম রাজস্ব থেকে এবং বিদেশি ঋণ থেকে স্বাস্থ্য খাতে বড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়নে এ ধরনের পিছিয়ে থাকাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে এ ভুল থেকে যে শিক্ষা সেটা কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনা দীর্ঘায়িত হতে পারে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেটে বরাদ্দ নির্ধারণ, মানসম্পন্ন বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নজরদারি বাড়ানোর দিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদন বিশ্নেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ১১ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে গত ৯ মাসে ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র দুই হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা এখনও অব্যবহূত পড়ে আছে। আগামী অর্থবছর শেষ হতে আর তিন মাস বাকি। এই সময়ে এই টাকা খরচ করতে হবে। বাস্তবায়ন অভিজ্ঞতা এবং চলতি প্রবণতা অনুযায়ী তার কোনো সম্ভাবনাই নেই। চলতি এডিপিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ মোট এডিপির ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।

জানতে চাইলে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী গতকাল বলেন, করোনাকালে গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেওয়ার পরও স্বাস্থ্য বিভাগের অগ্রগতি কম। এটা দুঃখজনক। তবে আর্থিক অগ্রগতি যতটা কম দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত অগ্রগতি হয়তো এতটা কম নয়। সচিব বলেন, তারা তাগাদা দিচ্ছেন। দেখা যাক আগামীতে কতটা গতি ফেরানো যায়।

চলতি অর্থবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য ও সেবা বিভাগে সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৫ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। মোট বরাদ্দের মধ্যে বিদেশি ঋণ ছিল ৬ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। গত ৯ মাসে বিদেশি ঋণসহায়তাপুষ্ট প্রকল্পগুলোতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি উৎস থেকে ব্যয়ের তথ্যে দেখা যায়, গত ৯ মাসে এই উৎস থেকে ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারি বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বাস্তবায়নাধীন মোট প্রকল্পের সংখ্যা ৫৩টি। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প সংখ্যা ৩০টি।

সূত্র : সমকাল
এন এইচ, ২৮ এপ্রিল

Back to top button