স্বাধীন ভারতে প্রথমবার ফাঁসি হতে চলেছে নারী আসামির
নয়াদিল্লী, ২৬ এপ্রিল – সাহায্যের জন্য নারীর কান্নার শব্দে উত্তর প্রদেশের বাওয়ান খেরি গ্রামের প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙে রাত ২টার দিকে। ঘুমকাতুরে চোখে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ দৃশ্য।
২০০৮ সালের ১৫ এপ্রিল দুতলা বাড়িতে প্রথম হাজির হওয়া মানুষের একজন লতিফ উল্লাহ খান দেখতে পান, গ্রামের শবনম মেঝেতে পড়ে আছে বাবা শওকত আলীর পাশে, যার গলা কাটা।
শবনমের দুই ভাই, তার মা, ভাবি, ১৪ বছরের কাজিন রক্তাক্ত ঘরে প্রায় শিরশ্ছেদ অবস্থায় রয়েছে। তার ভাইয়ের সন্তানকে পরে পাওয়া গেছে। তাকেও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। সে পড়েছিল মা-বাবার দেহের মাঝখানে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভারতজুড়ে তুমুল আলোচিত হয়। শুধু যে শবনম ১০ মাসের শিশুসহ পরিবারের সাত সদস্যকে খুন করেছে সেজন্য নয়, কিন্তু ওই খুনগুলো করার সময় সে নিজেও আট সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। শবনম ও তার প্রেমিক সেলিম এই হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাদেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় দেন আদালত।
শবনমের ফাঁসি কার্যকর হলে তা হবে স্বাধীন ভারতে প্রথম নারীর মৃত্যুদণ্ড।
ফাঁসি কার্যকরের দিন যত এগিয়ে আসছে তার আইনজীবী দল তা ঠেকানোর চেষ্টা করছে। তাদের দাবি, শবনম নিজেও ভুক্তভোগ। আইনজীবী শ্রেয়া রাস্তোগি জানান, তার মক্কেল কখনও হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেনি। সে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিপীড়িত, যেখানে জাত প্রথাকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়।
ওই রাতে খুন হওয়া ব্যক্তিরা ছাড়াও এই হত্যাকাণ্ডে আরেকজন ভুক্তভোগীর জন্ম হয়েছে। শবনম ও সেলিমের সন্তান বিট্টু (ছদ্মনাম)। তাকে অন্যের দায়িত্বে দেওয়ার আগ পর্যন্ত কারাগারেই লালন-পালন করে শবনম।
এখন ১২ বছরের বিট্টুও ভারতের প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দের কাছে মাকে ক্ষমা করার জন্য আবেদন করেছে।
যে কারণে এই হত্যাকাণ্ড
শবনম ও সেলিম ছিলেন তরুণ প্রেমিক, যারা একই গ্রামে বাস করতো। কিন্তু তাদের পরিবার এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি।
হত্যাকাণ্ডের সময় শবনমের বয়স ছিল ২২ বছর, স্থানীয় সাইফি গোত্রের একজন শিক্ষক। সেলিমের বয়স ছিল ২৩ বছর এবং সে ছিল বেকার পাঠান তরুণ।
ভারতে জাত প্রথা হিন্দু ধর্মালম্বীদের মধ্যে থাকলেও একই ধরনের সামজিক উঁচু-নিচু প্রকারভেদ মুসলিম পরিবারেও বিরাজ করে। সামাজিক অবস্থান বা পেশা ও আরবের কোন এলাকা থেকে তার ওপর ভিত্তি করে এই শ্রেণিবিভাজন হয়ে থাকে।
অনেক সময়েই পরিবার থেকে নিজেদের কমিউনিটিতে বিয়ের জন্য সন্তানদের চাপ দেওয়া হয়। পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে না নিলে সহিংসতা, এমনকি অনার কিলিংয়ের শিকার হতে হয়। যে প্রথায় পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে সন্তানকে হত্যা করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের আগে শবনমের নিহত ভাবি আনজুমের বাবা লাল মোহাম্মদ পুলিশকে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। আনজুমের বলা কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, শবনম ভুল পথে যাচ্ছিল। সে সেলিমকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু পরিবারের অবস্থা ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ।
শবনম যে স্কুলে শিক্ষকতা করত সেখানকার সহকর্মী নিশ্চয় ত্যাগী আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে জানিয়েছেন, সেলিমকে বিয়ে করার কথা শবনম তাকে বলেছে। কিন্তু তার পরিবার বিরোধিতা করছে। সেলিম অনেক সময় শবনমের বাড়িতে দেখা করতে আসত। কিন্তু তার (শবনম) বাবা এটি পছন্দ করতেন না।
আদালতে বলা হয়েছে, শবনমের পরিবার জানতো না যে সে অন্তঃসত্ত্বা। তার গর্ভে ছিল সেলিমের সন্তান।
রায়ে ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক এসএএ হুসাইনি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, স্থানীয়রা হারাম কর্মকাণ্ড (বিয়ে বহির্ভূত সন্তান) মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সাত জনকে হত্যা না করে এই বাওয়ান খেরির রক্ষণশীল সমাজ থেকে পালানোর মতো পথ তাদের সামনে ছিল।
এটি স্পষ্ট নয় শবনম হত্যাকাণ্ডে সময় সে যে আট সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা তা জানত কিনা।
প্রসিকিউশন জানিয়েছে, সে জানত এবং এটিই ছিল হত্যাকাণ্ডের মোটিভের একাংশ। তাদের দাবি, শবনম সবাইকে হত্যা করে নিজেকে পরিবারের সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী করতে চেয়েছে। যাতে করে সে সেলিম ও তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করে পারে।
শবনমের আইনজীবী রাস্তোগি জানান, প্রসিকিউশন এই তত্ত্ব প্রমাণে কোনও প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। গ্রেফতারের পর নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপের সময় শবনম অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে।
যেভাবে হয় হত্যাকাণ্ড
পুলিশের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনার দিন শবনম প্রথমে ঘুমের ঔষধ মেশানো দুধ পান করিয়ে পরিবারের সদস্যদের অচেতন করে। এরপর তার প্রেমিক সেলিমকে ডেকে আনে এবং দুজনে মিলে কুড়াল দিয়ে গলা কেটে হত্যা করে পরিবারের ৬ সদস্যকে।
কাজ শেষে সেলিম বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর হঠাৎ ৯ মাসের ভাতিজার কান্না শুনে চমকে উঠে শবনম। উপায় না দেখে অন্ধকার ঘরে দু’পায়ের ফাঁকে টর্চ আটকে, ৯ মাসের শিশুটির মুখ চেপে ধরে ছুরির আঘাতে হত্যা করে সে।
শবনমের পরিবারের অপরাধ, ষষ্ঠ শ্রেণি পাস দিনমজুরের কাছে তাদের দুই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি।
হত্যার ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছিল উত্তরপ্রদেশের আমরোহার বাওয়ান খেড়ি গ্রাম। সেই ঘটনার প্রভাব এতটাই ভয়ংকর যে আজও ওই গ্রামে কোনও শিশুর নাম শবনম রাখা হয় না।
ক্ষমার আবেদন
আইনজীবী রাস্তোগি মনে করেন, শবনমকে অন্যায্যভাবে অবমাননা করা হচ্ছে এবং তার মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা উচিত।
২০১০ সালে শবনম এবং সেলিম, দু’জনকেই দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদান করেন আমরোহার দায়রা আদালত। সাজা মওকুফের গত ১১ বছরে ইলাহাবাদ হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট এবং রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছে শবনম।
কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তার সেই আবেদন খারিজ করে দেয় উচ্চ আদালত। বিচারবিভাগীয় কমিটির কাছে আবেদনটি পুনর্বিবেচনা করে দেখা এবং কিউরেটিভ পিটিশন দায়ের করার উপায় এখনও শবনমের হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সব আইনি দরজা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত শবনমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে না। তবে এখনও মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হতে পারে। কারণ শবনমের ফাঁসি কার্যকর করার দিন ক্ষণ এবং সময় ঠিক করতে আমরোহা দায়রা আদালতে ইতোমধ্যেই আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শবনম ও সেলিমের আইনজীবী উত্তর প্রদেশের গভর্নরের কাছে ক্ষমার আবেদন করেছেন। দেশের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে এই আবেদন করা হয়। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমার আবেদন জানানো হয়।
রাস্তোগির মতে, আইন অনুসারে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে আদালতকে অপরাধের বাইরে পুনর্বাসন ও শোধরানোর সম্ভাবনা দেখা উচিত।
তিনি প্রশ্ন করেন, এক তরুণ মাকে জানার জন্য সন্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখার চেয়ে আর কোনও ভালো উপায় কি আছে?
ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষা
ফেব্রুয়ারিতে ভারতের একমাত্র বেঁচে থাকা জল্লাদ মথুরা কারাগার পরিদর্শন করলে শবনমের ফাঁসির বিষয়টি আবারও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। ১৫০ বছর আগে তৈরি মথুরা কারাগারেই শুধু নারীদের ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা রয়েছে।
মথুরা জেলের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট শৈলেন্দ্র মৈত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ফাঁসিকাষ্ঠের মঞ্চে কিছু সমস্যা ছিল। সেগুলো ঠিক করা হচ্ছে। বিহারের বক্সার জেল থেকে ফাঁসির দড়ি চেয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে।
জেল জল্লাদ পবন সবকিছু পর্যবেক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। তবে এখনও পর্যন্ত মৃত্যুর পরোয়ানা তাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন শবনমের আইনজীবীরা।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এইচ, ২৬ এপ্রিল