ঢাকা, ২৪ এপ্রিল – কেবল রাজধানী ঢাকা কিংবা জেলা শহরগুলোতে নয়, মফস্বলের মাঠপর্যায়ের হেফাজত নেতারাও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়ি ছাড়া হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাত কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে বিশাল জনসমাগমের পর আবারও সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনায় উঠে আসে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন শুরু করে সংগঠনটি।
এর পর থেকে হেফজতের দিকে গভীরভাবে নজরদারি করতে শুরু করে সরকার। আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, ওইসব তাণ্ডবে হেফাজতের যেসব নেতাকর্মীরা ইন্ধন যুগিয়েছে অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের একে একে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নাশকতা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করতে সারা দেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
নরম-গরম কৌশলী অবস্থানে সরকার
দেশের কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক ইস্যুতে নরমে-গরমে কৌশলী অবস্থান নিয়েছে সরকার। গত ২৬ মার্চ থেকে হেফাজতের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর পল্টন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হাটহাজারী, হবিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সহিংস ঘটনার সঙ্গে সরাসরি ও নেপথ্যে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে সরকার কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়। একই সঙ্গে ২০১৩ সালে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে যে সহিংসতা হয়েছিল, সেই মামলাগুলোও সামনে এনে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগোচ্ছে সরকারের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।
হেফজতের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন
হেফাজতে ইসলামের বর্তমান নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। চলমান প্রেক্ষাপটে হেফাজতের কোনো কোনো নেতা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বললেও সংগঠনটির এখনকার নেতৃত্ব নিয়েই সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতিবাচক মনোভাব বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে।
তবে সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলাম ও এর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী-সমর্থকের বিষয়ে এখনই বিপরীত অবস্থানে যাওয়ার পক্ষে নয় সরকার। কারণ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল মনে করছে, সহিংসতা ও সরকারবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে হেফাজতের সবাই জড়িত নয়। সরকারের এই অবস্থানের পরিষ্কার বার্তা মেলে গত ৪ এপ্রিল চলতি একাদশ জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া সমাপনী বক্তব্যে।
ওই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন ঘিরে যে সংঘাত-সহিংসতা হয়েছে সেটি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘হেফাজতের সবাই যে এর মধ্যে জড়িত, তাও কিন্তু নয়। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
ধাপে ধাপে গ্রেপ্তার হচ্ছে হেফাজতের নেতাকর্মীরা
হেফাজতের নেতাদের অভিযোগ, এ পর্যন্ত তাদের সংগঠনের আলোচিত নেতা মামুনুল হকসহ ১৬ জন কেন্দ্রীয় নেতা এবং মাঠপর্যায়ে শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও নজরদারীতে রয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় অর্ধশত নেতা।
হেফাজত নেতারা বলছেন, সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে তাদের মাঠ পর্যায়ের নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্গে রয়েছেন। তারা বাড়ি ছাড়া হয়ে একেক দিন একেক জায়গায় অবস্থান করছেন। চলমান পরিস্থিতিতে কোনো রকম জ্বালাও-পোড়াও কিংবা সহিংসতায় না গিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী। গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে বাবুনগরী বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম দেশে নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস চায় না। হেফাজতে ইসলাম একটি সুশৃঙ্খল ও শান্তিপ্রিয় সংগঠন।’ একই দিনে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতায় কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সংগঠনের কিছু নেতা ব্যক্তিগতভাবে তাদের বক্তব্যে বিষয়টিকে সামনে এনেছেন।’
সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যেতে চায় হেফাজত
হেফাজতে ইসলামের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চলমান পরিস্থিতিতে এখনই আন্দোলনের কর্মসূচিতে যাওয়ার পক্ষে নন তারা। বরং সংগঠনের নেতৃত্বে মুরব্বি এবং অরাজনৈতিক নেতা যারা আছেন, তাদের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টাকেই উত্তম পথ বলে তারা মনে করছেন।
সম্প্রতি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদী বলেছেন, পুরো পরিস্থিতি হেফাজতকে সংকটে ফেলেছে। এখন তারা গ্রেপ্তারকৃতদের জন্য আইনি লড়াই চালাবেন এবং একই সঙ্গে তারা সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছেন।
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টার অংশ হিসেবেই সংগঠনের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জেহাদীর নেতৃত্বে গত সোমবার (১৯ এপ্রিল) রাতে হেফাজতে ইসলামের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেছেন। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, হেফাজত নেতাদের যাতে গণগ্রেপ্তার না করা হয় তারা সেই দাবি জানিয়েছেন।
যা বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সম্প্রতি হেফাজতের সঙ্গে নিজ বাসায় বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ ও সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী-নেতারা যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি বিশ্লেষণ করলেও যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হলো- সরকার বা প্রশাসন ঢালাওভাবে হেফাজতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে না, বরং সরকার কৌশলী ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোনো গণগ্রেপ্তার হচ্ছে না। যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, ঠিক তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হেফাজত নেতারা কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর গত মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ‘সহিংসতার ঘটনায় কোনো দল বা আলেম-ওলামা দেখে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যারা এ তাণ্ডবলীলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, বাড়িঘরে হামলা ও আগুন দিয়েছে, তাদের ভিডিও দেখে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সারা দেশে হেফাজত নেতাদের তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে
দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের তাণ্ডবের পর সারা দেশেই দলটির নেতাদের নাম-পরিচয়ের তালিকা সংগ্রহ করছে আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, জেলা পর্যায়ের থানাগুলো নাশকতাসৃষ্টিকারী হেফাজত নেতাদের তালিকা তৈরি করছে। প্রয়োজনে তাদের তথ্য হালনাগাদ করা হচ্ছে। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের তথ্য ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে কাউকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হয়রানি করা হচ্ছে না।
এদিকে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (অপারেশন্স এন্ড ইন্টেলিজেন্স) জনাব নুরেআলম মিনা বলেন, আমরা এখন তালিকার উপর জোর না দিয়ে সহিংসতায় যে বা যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। যেসব স্থানে ঘটনা ঘটেছে, ওইসব স্থানের থানায় মামলা দায়ের হচ্ছে এবং সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
সূত্র : আরটিভি
এন এইচ, ২৪ এপ্রিল