জাতীয়

যে ২ কারণে ভয়াবহ পর্যায়ে করোনা সংক্রমণ

এমএকে জিলানী

ঢাকা, ২৩ এপ্রিল – মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফের ব্যাপকভাবে ঊর্ধ্বমুখী করোনাভাইরাস সংক্রমণের গ্রাফ। গত বছর যে শীর্ষ স্পর্শ করেছিল, এবার তাকেও ছাড়িয়ে গেছে সংক্রমণ। বেড়েছে মৃত্যুও। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে গাফিলতি এবং করোনার ভ্যারিয়েন্টস ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ না করা ও এগুলোর তথ্য সময়মতো প্রকাশ না করাকেই করোনা সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির কারণ বলে মনে করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কৃতি সংগঠক অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হয়। গত বছর পর্যন্ত এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মারা গিয়েছিলেন ৩০ জুন। তবে এ বছরের এপ্রিলে এসে ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু পেরিয়ে যায় শতকের ঘর। একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জন পর্যন্ত মৃত্যুও ঘটেছে।

এদিকে, গত বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৬৪ জনের ‍মৃত্যু হয়েছিল করোনা সংক্রমণ নিয়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছরের এপ্রিলের প্রথম ১৮ দিনেই করোনায় মৃত্যু ছাড়িয়ে গেছে গত বছরের জুলাইকে। এই ১৮ দিনে মারা গেছেন এক হাজার ৩৩৯ জন। এর আগে এত কম সময়ের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়ে এক হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটনা দেশে ঘটেনি।

কেবল করোনা সংক্রমণে মৃত্যুই নয়, করোনা সংক্রমণও মাত্রা ছাড়িয়েছে এ বছর। গত বছর যেখানে একদিনে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১৯ জনের মধ্যে এই সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল, সেখানে এ বছর একদিনে সংক্রমণ সাত হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে ছয় দিন। গত বছরের জুনে একমাসে সর্বোচ্চ ৯৮ হাজার ৩৩০টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল দেশে। সেখানে এপ্রিলের প্রথম ১৬ দিনে সংক্রমণ শনাক্তের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে লাখের ঘর।

এ বছরে এসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এমন মাত্রাছাড়া হওয়ার পেছনে দুইটি কারণকে প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করছেন অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, প্রথমত, আমরা খুব রিল্যাক্সড হয়ে গিয়েছিলাম। এটার কেবল সাধারণ জনগণ নয়; সরকার, প্রশাসন, পেশাজীবীসহ আমরা সবাই এক ধরনের আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। বেশি শিথিল হয়ে উঠেছিলাম। এখন তার খেসারত দিচ্ছি।

দ্বিতীয় কারণ তুলে ধরে অধ্যাপক লিয়াকত বলেন, করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টস। করোনার অনেক ভ্যারিয়েন্টস আগে এসেছে, কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো প্রেডিক্ট করা হয়নি। এগুলো সম্পর্কে মানুষকে আগে থেকে সতর্ক করা হয়নি। এগুলো কিছুটা অবহেলা করে রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন পর্যায়েই অনুষ্ঠান হয়েছে। এখন এই দুইটি বিষয়— আমাদের অসতর্কতা ও ভ্যারিয়েন্ট— একসঙ্গে মিলে গেছে। এই দুইটি মিলেই বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গত একবছরের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের দিকে জোর দেন ডা. লিয়াকত। তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে হবে কোন কোন বিষয়গুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলোর স্কোরিং করতে হবে। যেমন— ইনডোরে ঝুঁকি বেশি, ভেন্টিলেশন রুমে থাকলে ঝুঁকি বেশি, আউটডোরের তুলনায় ইনডোরে একসঙ্গে বেশি লোক থাকলে ঝুঁকি বেশি, বাতাস যেখানে জমে থাকে সেখানে ঝুঁকি বেশি ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো যখন জানা গেছে, তখন প্রথমবারে যে জেনারালাইজড লকডাউন, সেই লকডাউন অ্যাভয়েড করা যেত যদি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বা বিষয়গুলো নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করা যেত।

তিনি বলেন, ঝুঁকিরও স্কোরিং করা যায়, ইন্টারভেনশনেরও স্কোরিং করা যায়। ইন্টারভেনশন স্কোরিংয়ে টেকনোলজি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এতে অনেকগুলো টেস্ট করতে হয়। অ্যান্টিজেন টেস্ট, সিকোয়েন্সিংয়ের ব্যবহার, কোথায় কোন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে গেল, কোথায় বেশি সতর্ক হতে হবে— এসব বিষয় ছিল। শুধু সীমান্ত না, র‌্যানডমলি কিছু চেকিংও প্রয়োজন ছিল। এখন সার্বিক পরিস্থিতিতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে লকডাউনও শিথিলভাবে চলছে। কিন্তু তারপরও তাতে কিছু ফল পাওয়া যাবে। এই ফল আরও কয়েকদিন পর থেকে আমরা পেতে শুরু করব।

লকডাউনকেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় মনে করছেন না ডা. লিয়াকত। গণহারে লকডাউনের পরিবর্তে বরং তিনি ‘টার্গেটেড ইন্টারভেনশন’কে বেশি কার্যকর মনে করছেন।

তিনি বলেন, লকডাউন কোনো ম্যাজিক বুলেট না। আমাদের আরও অনেকগুলো পদক্ষেপ বা টার্গেটেড ইন্টারভেনশন নিতে হবে। যেমন— বিপণী বিতানগুলোতে কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা যাবে, কাঁচাবাজার কিভাবে উন্মুক্ত স্থানে আনা যাবে, অফিস-আদালতে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন না থাকলে সেখানে কী হবে, গণপরিবহনে কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা যাবে— এমন বিষয়গুলো নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ টার্গেটেড ইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করতে হবে। আবার বিপণী বিতানসহ যাদের কাজ বন্ধ রাখতে হবে, তাদের কিভাবে ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুষিয়ে দেওয়া যাবে, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। কেননা আমাদের সব এলাকার সবকিছু বন্ধ করার মতো সামর্থ্য নাই। তাই টার্গেটেড ইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করতে হবে।

এর জন্য জনসচেতনতা গড়ে তোলার তাগিদ দিচ্ছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, এগুলো বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো গণসম্পৃক্ততা। এলাকাবাসীর মধ্যে যদি সচেতনতা না থাকে, এলাকাবাসী যদি সংগঠিত না থাকে, তাহলে প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে কিছু হবে না। তাই এগুলোর জন্য সচেতনতা বা সংগঠন যেভাবে গড়ে তোলা দরকার, যতক্ষণ সেগুলো না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এই ধরনের বিধিনিষেধ ঠিকমতো পালিত হয় না। আমাদেরও ওই জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে, পাড়া-মহল্লার সংগঠনকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা আমাদের যে অবস্থা তাতে রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে হত-দরিদ্র বা বঞ্চিত মানুষের দায়িত্ব নিতে পারবে— এমনটা আশা করা ঠিক না। সামাজিক সংগঠনগুলোও এগিয়ে আসছে না। গতবার যাও এগিয়ে এসেছিল, এবার কিন্তু তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না।

অধ্যাপক ডা. লিয়াকত বলেন, কঠোর লকডাউন আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য না। তাই বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ফ্রন্টে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রচুর পরীক্ষা করতে হবে। সবকিছুতে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এনে আমাদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করতে হবে। এই প্রস্তুতির পর বায়োলজিক্যাল অস্ত্র বা অ্যান্টিবডি— তার ওপর জোর দিতে হবে। গত বছর থেকে আমরা এগুলো বলে আসছি, কিন্তু তেমন কিছু হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমাদের শরীরে এখন পুষ্টি থাকতে হবে। সেই সঙ্গে প্রোটিন, ভিটামিন— এগুলোর মাত্রাও যথাযথ থাকতে হবে। খাদ্য নিরপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আর এই সময়ের খাদ্য নিরাপত্তা অন্য সময় (বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক দুর্যাগ) থেকে ভিন্ন। তাই এখন পুষ্টি নিরাপত্তা বলাই শ্রেয়। এজন্য এই লকডাউনে মানুষকে ক্ষুধা থেকে বাঁচানোই কিন্তু যথেষ্ট নয়। অন্য দেশ যারা লকডাউন করেছে, তারা সম্পূর্ণ পুষ্টিকর প্যাকেজ খাবার তাদের জনগণকে সরবরাহ করতে পেরেছে। তাই তাদের জন্য লকডাউন ঠিক আছে।

সূত্র : সারাবাংলা
এন এ/ ২৩ এপ্রিল

Back to top button