অভিমত/মতামত

যে ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্র

রুস্তম আলী খোকন

রাষ্ট্রটি গঠিত হয়েছিল ভেঙে যাওয়ার জন্য। পাকিস্তান নিয়ে এর চেয়ে ভালো মন্তব্য খুঁজে বের করা কঠিন। পাকিস্তান সৃষ্টিতে পূর্ব বাংলার তরুণ-তরুণীদের উন্মাদনা ছিল- শুধুই উন্মাদনা। কর্পূরের মতন সেই উন্মাদনা উবে গিয়ে জাতিসত্ত্বাবোধ জাগ্রত হতে সময় লেগেছিল মাত্র ছয় মাস। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকরা নিজেদের সাচ্চা মুসলমান মনে করতেন। তাদের দৃষ্টিতে বাংলা ছিল আতরাফ মুসলমান আর হিন্দুদের ভাষা। পাকিস্তান যখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে চাইল না, তখন সেই সময়ের বাঙালি তরুণ-তরুণীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাষার মর্যাদার রক্ষার্থে। সৃষ্টি হয়েছিল মুসলিম জাতিসত্তাবোধের বিপরীতে বাঙালি জাতিসত্তাবোধের। ওই সময় মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ছিল। তার বিপরীতে কোনো বিরোধী দল ছিল না পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়। মাওলানা ভাসানী আর শামসুল হক হন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তরুণ শেখ মুজিব হন যুগ্ম সম্পাদক। বাইশ বছর পর এই মুজিবই হন বাংলাদেশ সৃষ্টির নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রজনক।

খ.
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন হয় পাকিস্তানে। কথা ছিল এই নির্বাচিত পার্লামেন্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন করবে। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি ব্যতীত সব আসন আওয়ামী লীগ পেয়ে যায়, ফলে মুজিবই হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এমনটা ভাবেননি। পরবর্তী সময়ে যা হয়েছে, তা শুধুই রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ। বিকারগ্রস্ত পাকিস্তান সেনা ও শাসকগোষ্ঠীর পৈশাচিকতা। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চিন্তার কথা জানতেন। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তেহরিক-ই-ইস্তিকলাল পার্টির সভাপতি এয়ার ভাইস মার্শাল ( অব.) আসগর খানের কাছে শেখ মুজিব যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে তা-ই ঘটেছিল। মুজিব আসগর খানকে বলেছিলেন, ‘এটি পরিস্কার যে, ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন, তারপর আসবেন পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান মির্জা মুজাফ্‌ফর আহমদ, তারপর আসবেন ভুট্টো। এরপর ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবেন এবং এভাবেই শেষ হয়ে যাবে পাকিস্তান।’ মুজিব আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাকে বন্দি করা হবে নতুবা তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিংবা তার নিজের লোকদের হাতে মারা যাবেন। – (পৃষ্ঠা ৫০, মহিউদ্দিন আহমেদ, যুদ্ধদিনের কথা, আওয়ামী লীগ)

গ.
১৯৭১ সালে ঢাকা শহরে লোকসংখ্যা ছিল বড়জোর দশ লাখ। এর একটা অংশ ভারতীয় বিহারি মুসলমান। এরা ঘোরতর পাকিস্তানি সমর্থক ছিল। সেই শহরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর রাতের অন্ধকারে সশস্ত্র একটি সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল। পাখির মতন গুলি করে সারারাত মানুষ মেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি ঢাকায় সংঘটিত করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পঁচিশে মার্চ রাতে। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয় সেই রাতেই। তাজউদ্দীন আহমদ সেই রাতেই অবস্থান নেন লালমাটিয়ায় রেলের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাসায়। তার সঙ্গে আমীর-উল ইসলাম ছিলেন। ২৭ মার্চ লুঙ্গি আর হাফহাতা শার্ট পরে তাজউদ্দীন রওনা হন ভারতের উদ্দেশে। কেরানীগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর হয়ে কখনও হেঁটে, কখনও-বা গরুর গাড়িতে, কখনও-বা গাড়িতে- এমনি করে মেহেরপুর পৌঁছেন ৩০ মার্চ বিকেলে। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আর পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুবকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর নিকট পাঠিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অপেক্ষা করতে থাকেন নদীয়া আর কুষ্টিয়া জেলার মাঝে টুঙ্গি নামক নির্জন স্থানে। সন্ধ্যার ঠিক আগে বিএসএফের পক্ষ থেকে অভিবাদন জানিয়ে বলেন- ‘স্যার, ইউ আর ইনভাইটেড টু কাম টু আওয়ার ক্যাম্প।’ খবরটি দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তাজউদ্দীন আহমদ আর ব্যারিস্টার আমীর-উলকে নেওয়া হলো আসাম সেন্টারে। ১ এপ্রিল রাত ১০টায় একটি সামরিক মালবাহী বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ রওনা দিলেন দিল্লির উদ্দেশে। সঙ্গী তিনজন- ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় আইজি গোলক মজুমদার, নিরাপত্তা কর্মকর্তা শরদিন্দু দস্তিদার।

ঘ.
শেখ মুজিবের নির্দেশে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ একটি স্বাধীনতার খসড়া তৈরি করে তার হাতে তুলে দেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং ড. কামাল হোসেন। সেই খসড়া ঘোষণা সৃষ্টিতে আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। পঁচিশে মার্চের রাতের এই ঘোষণাটি পরদিন ২৬ মার্চ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ২৫ মার্চ দুপুরে ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম নুরুল হক আমীর-উল ইসলামকে জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে খুলনা থেকে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার নিয়ে আসা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক আরও বলেছিলেন, তিনি জানেন কী বলতে হবে। চট্টগ্রামের এম এ হান্নান শহরে মাইকিং করে একটা ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে একটি ঘোষণা পাঠ করেন।

ঙ.
দিল্লিতে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পেয়ে যান লেখক বুদ্ধিজীবী রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান, আইনজীবী সিরাজুল হক, রাজনীতিক এম আর সিদ্দিকী, আব্দুর রউফ প্রমুখকে। ড. অশোক মিত্র যিনি পরে সিপিএমের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, অমর্ত্য সেনের সহযোগিতায় রেহমান সোবহান ইন্দিরা গান্ধীর সচিব পি এন ধরের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক করাতে সমর্থ হন। তারপর মিসেস গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার সঙ্গেও অনুরূপ একটি সভা করেন।

অবশেষে ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ১০ নং সফদর জং রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে মিসেস গান্ধীর দেখা হয়। মিসেস গান্ধী সহযোগিতার সম্মতি দেন। সরকার গঠনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। দিল্লিতেই রেহমান সোবহান স্বাধীনতার খসড়া ঘোষণা ড্রাফট করেন, তাকে সহযোগিতা করেন আমীর-উল ইসলাম। রেহমান সোবহানকে মস্কোপন্থি বাঁমঘেষা অর্থনীতিবিদ মনে করা হতো। তিনি নতুন দেশটির একটি নামও দেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ৪ থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে দিল্লিতে বসে তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি শাসিত একটি অস্থায়ী সরকারের কাঠামো নির্মিত করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় সেই সরকারের অবয়ব; কিন্তু তখনও তা অপ্রকাশিত। দিল্লিতেই রেকর্ড করা হয় তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ।

১০ এপ্রিল ১৯৭১ রাত ১০টায় শিলিগুড়ির কোনো এক জঙ্গলের ভেতর স্থাপিত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ। সত্যিকার অর্থে তাজউদ্দীন আহমদের ১০ এপ্রিলের সেই ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে ২৫ মার্চ কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞের কথা বলা হয়েছে, শেখ মুজিবের কথা বলা হয়েছে, প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে, নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। এটি হাজার বছরের বাঙালির প্রথম স্বাধীন ক্ষমতায়নের সূচনালগ্ন।

পরের দিন ১১ এপ্রিল ভারত সরকারের দেওয়া একটা ডাকোটা বিমানে চড়ে তাজউদ্দীন আহমদ একে একে খুঁজে বের করেন অন্য নেতাদের। নির্ধারণ করা হয় ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে এই সরকারের শপথ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ বাকের আলী কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন টাঙ্গাইলের গণপরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান। স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়- ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর হইবে।’ পৃথিবীর আরেকটি রাষ্ট্র স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে আইনানুগ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সূত্র : সমকাল
এন এ/ ১৮ এপ্রিল

Back to top button