সুনামগঞ্জ

হামলা হতে পারে জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি সুনামগঞ্জের পুলিশ

খলিল রহমান

সুনামগঞ্জ, ২০ মার্চ – সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হতে পারে আঁচ করে বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছিলেন গ্রামবাসী। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, হামলা হবে না তাঁদের গ্রামে। কিন্তু পরদিন নোয়াগাঁও গ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘটে ভয়াবহ হামলা। বাড়িঘর-মন্দির ভাঙচুরের সঙ্গে চলে লুটপাট।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বলেছেন, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে এই হামলা প্রতিরোধ করা যেত। আর পুলিশ বলছে, বিক্ষোভকারীরা হামলা করবে না বলে কথা দিয়েছিল।

দিরাই উপজেলায় হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশ হয় গত সোমবার। এতে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী ও মাওলানা মামুনুল হক বক্তব্য দেন। পরদিন মঙ্গলবার নোয়াগাঁও গ্রামের যুবক ঝুমন দাশ ওরফে আপনের বিরুদ্ধে মামুনুল হককে কটূক্তি করে ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই দিন সন্ধ্যায় পাশের কাশিপুর গ্রামে এ নিয়ে বিক্ষোভ হয়। পরে বিষয়টি পার্শ্ববর্তী দিরাই উপজেলার নাচনি, সন্তোষপুর ও চন্ডীপুর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এই পাঁচ গ্রামের লোকজন ঝুমনকে গ্রেপ্তারের দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ করে।

আরও পড়ুন : শাল্লায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলার প্রধান আসামি গ্রেপ্তার

কাশিপুর গ্রামের বাসিন্দা অলিউল হক শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তিনি জানান, বিক্ষোভের বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন। এরপর উপজেলা চেয়ারম্যান রাতেই ওই গ্রামগুলোতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। ওই রাতে ঝুমন দাশকে নোয়াগাঁও গ্রামবাসী আটক করে পুলিশে দিলে সেটিও বিক্ষোভকারীদের জানানো হয়।

নোয়াগাঁও গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন ব্যক্তি জানান, হামলার দিন বুধবার সকালে কাশিপুর গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে নোয়াগাঁও গ্রামে গিয়ে হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। সবাইকে সে গ্রামে একত্র হয়ে যাওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এরপর আশপাশের গ্রামের লোকজন হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন খবর পেয়ে আবারও পুলিশকে জানান নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা। একই সঙ্গে গ্রামের এক ব্যক্তি ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে পুলিশকে খবর দেন। এরপর পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে যান। তখন নোয়াগাঁও গ্রামের পাশের দাড়াইন নদের তীরে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হয়েছেন। প্রশাসন, পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের একদিকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন, অন্যদিকে একটি অংশ গ্রামে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়ে যান।

হামলাকারীরা কথা রাখেনি: পুলিশ

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তি জানান, হেফাজত অনুসারীদের সভা-সমাবেশের খবর তাঁরা মুঠোফোনে ও মৌখিকভাবে পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তা দেওয়া তো দূরের কথা, হামলার আগে পুলিশ একবারের জন্যও গ্রামে আসেনি। ঘটনার পর তাদের তৎপরতা বাড়ে। গ্রামে র‌্যাব ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে এ ঘটনা প্রতিহত করা যেত। পুলিশের নির্দেশনা অনুযায়ীই ঝুমন দাশকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন তাঁরা। এরপর পুলিশ থেকে বলা হয়েছিল, ‘হেফাজত অনুসারীরা’ গ্রামে হামলা করবে না। এর বাইরে উত্তেজনা প্রশমনে তারা কিছু করেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক বলেন, ‘ঝুমনের ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর কয়েকটি গ্রামের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে মিছিল-সমাবেশ করে। পরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আমাদের জানিয়েছিল, নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা করবে না। অথচ তারা সে কথা রাখেনি। বুধবার সকালে অতর্কিতভাবে মানুষজন সেখানে হামলা চালায়। খবর পেয়ে দ্রুত আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। এখানে পুলিশের কোনো গাফিলতি ছিল না।’

উসকানি

নোয়াগাঁও গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, তাঁদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী বরাম হাওরের মধ্যে শাল্লা অংশে গোসাইর বিল ও নিত্যার দাইর নামে দুটি জলমহাল রয়েছে। এ দুটি বিল ওয়াক্ফ এস্টেট থেকে ইজারা এনে কয়েক বছর ধরে মাছ আহরণ করছেন নাচনি গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম ওরফে স্বাধীন এবং তাঁর লোকজন। ইজারার নীতিমালার শর্ত না মেনে তাঁরা পাম্প দিয়ে পানি সেচে মাছ ধরেন। এতে নোয়াগাঁওসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকেরা বোরো আবাদে সেচসংকটে পড়েন।

এ নিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ চন্দ্র দাস ও জগদীশ চন্দ্র দাস শাল্লা থানায় শহিদুল ইসলাম এবং তাঁর সহযোগী কেরামত আলী, মির্জা হোসেন, ফখর উদ্দিন ওরফে ফক্কন, আলাম উদ্দিনসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু এরপরও বিলে সেচ বন্ধ না হলে গত ২৫ জানুয়ারি পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজির কাছে আরেকটি অভিযোগ দেওয়া হয়।

দিরাই উপজেলা প্রশাসন ওই দিনই গোসাইর জলমহাল থেকে দুটি সেচপাম্পসহ ফখর উদ্দিনকে আটক করে। পরে তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জব্দ করা দুটি সেচপাম্প নিলামে বিক্রি করা হয় ৩৫ হাজার টাকায়। এ নিয়ে শহিদুল ইসলাম ও তাঁর সঙ্গীরা নানাভাবে নোয়াগাঁও গ্রামের লোকজনের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। হামলার পর থেকে তাঁদের নাম মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে বুধবারের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় শহিদুল ইসলামকে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

সূত্র : প্রথম আলো
এন এইচ, ২০ মার্চ

Back to top button