জাতীয়

এবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে বাতিলের শঙ্কায় ৩ হাজার ৭১৯ জন

আবু সালেহ রনি

ঢাকা, ১৫ মার্চ – বেআইনিভাবে ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গেজেটভুক্ত হওয়া তিন হাজার ৭১৯ জনের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি বাতিলের জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) সুপারিশ পাঠিয়েছে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি। ৪৯১টি উপজেলা ও মহানগর কমিটির মধ্যে ৩৭৯টি কমিটির প্রতিবেদন ১১ মার্চ পর্যন্ত জামুকায় জমা হয়েছে। এখনও প্রতিবেদন দেয়নি ১১২টি উপজেলা ও মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি। তাদেরকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জামুকায় পাঠাতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে গতকাল রোববার জামুকা কার্যালয়ে জামুকার ৭৩তম সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় উপজেলা ও মহানগর কমিটি থেকে গেজেট ও সনদ বাতিলের জন্য সুপারিশ করা তিন হাজার ৭১৯ জনকে আপিল করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা আগামী ১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। এ জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত আপিল ফরম ইস্যু করা হবে, যা মন্ত্রণালয় ও জামুকার ওয়েবসাইট থেকে সংক্ষুব্ধরা সংগ্রহ করতে পারবেন।

জামুকার সভায় সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেসব কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে (৩৭৯টি) এবং প্রতিবেদনে যাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নামঞ্জুর করা হয়েছে, তাদের আপিলের সুযোগ দেওয়া হবে। এ জন্য গঠন করা হবে পৃথক আপিল কমিটি। এ কমিটি বাদ পড়াদের পুনঃযাচাইয়ের পর যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটিই চূড়ান্ত ধরে নিয়ে আমরা তা বাস্তবায়ন করব।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশের ১১২ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাতে ই-মেইলে ‘অফিস আদেশ’ ইস্যু করেছে জামুকা। এতে বলা হয়েছে, জামুকার সুপারিশবিহীন গেজেট যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তিন কর্মদিবস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব উপজেলা থেকে এসব প্রতিবেদন পাঠানো হয়নি, যা দুঃখজনক। প্রতিবেদন না পাওয়ার কারণে একদিকে যেমন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বেসামরিক গেজেট নিয়মিতকরণ কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে, অপরদিকে উপজেলা পর্যায়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। এটি কোনোক্রমেই কাম্য নয়। এতে আগামী ২৬ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

আরও পড়ুন : বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশ না-নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত বিএনপির

এর আগে গত ৯ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং বঙ্গবন্ধুর চার খুনিবে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব বাতিলের সুপারিশ করে জামুকা। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানসহ বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে গঠন করা হয় তিন সদস্যের কমিটি। গতকালের সভায় সেই কমিটি গঠনসহ জামুকার ৭২তম মাসিক সভার কার্যপত্র অনুমোদন করা হয়। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, কার্যতালিকায় বিষয়টি ছিল না। তবে ৭২তম সভার রেজুলেশন অনুমোদন করা হয়েছে। এটিই রেওয়াজ।

জামুকার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকালের সভায় দৈনন্দিন কার্যসূচির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই সংক্রান্ত তিনটি বিষয় আলোচনার জন্য নির্ধারিত ছিল। এর মধ্যে বেআইনিভাবে গেজেটভুক্ত ‘বেসামরিক ও বিভিন্ন বাহিনীর বাতিলকৃত যাচাই-বাছাই কমিটি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৭৯টি উপজেলা ও মহানগর কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এসব উপজেলায় যাচাইয়ের জন্য মোট মুক্তিযোদ্ধা ২৬ হাজার ৩৮৯ জন। এর মধ্যে অনুমোদিত বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ১৬ হাজার ৬০, বিভিন্ন বাহিনীর অনুমোদিত মুক্তিযোদ্ধা ৬৩৩, দ্বিধাবিভক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক হাজার ৪৫, কমিটির নামঞ্জুরকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা তিন হাজার ৭১৯, অনুপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা এক হাজার ৩০৫, অন্য উপজেলায় যাচাইয়ের জন্য পাঠানো মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২৪ ও বাতিলকৃত গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৯।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩০ জানুয়ারি ও ৬ ফেব্রুয়ারি দেশের ৪৯১টি উপজেলায় বেআইনিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার ব্যক্তির যাচাই-বাছাই অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় এবং মহানগর পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এই যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালনা করে জামুকা মনোনীত চার সদস্যের কমিটি। এর আগে ১০ ডিসেম্বর আইন ও বিধিবহির্ভূতভাবে ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গেজেটভুক্ত হিসেবে ৩৯ হাজার ৯৬১ জনের নাম চূড়ান্ত করে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য প্রথম তালিকা প্রকাশ করে জামুকা। এ তালিকার ভিত্তিতে ১৯ ডিসেম্বর দেশের সব উপজেলা ও মহানগরে সংশ্নিষ্টদের যাচাই-বাছাই করার কথা ছিল। কিন্তু ওই তালিকায় জামুকার আইন ও নীতিমালা অনুযায়ী গেজেটভুক্ত বীরপ্রতীকসহ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম থাকায় বিতর্কের মুখে পড়ে জামুকা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। পরে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পিছিয়ে ৯ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। তবে তালিকা প্রণয়নের জটিলতায় ফের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি নির্ধারণ করে জামুকা।

জামুকা সূত্রে জানা যায়, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২ অনুযায়ী কোনো মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থীর তথ্য সংবলিত আবেদন প্রথমে নিজ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে যাচাই হয়। উপজেলা কমিটির সুপারিশে প্রাথমিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হলে ওই তালিকা জামুকায় পাঠানো হয়। জামুকার সভায় তদন্ত ও অনুমোদনের পর সংশ্নিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করে মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আইন ও বিধিবহির্ভূতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটভুক্ত করা হয়েছে, যা মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রে উঠে এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, দেশে এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৮। মোট ভাতাভোগী খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ, মুক্তিযোদ্ধাসহ দুই লাখ ছয় হাজার। যার মধ্যে সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা এক লাখ ৯২ হাজার। তবে তাদের মধ্যে গত বছর মার্চে চালু হওয়া মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল ডাটাবেজে এখন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত হয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা। অন্যদের নাম-ঠিকানার ভুলসহ বিভিন্ন কারণে ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব ভুল সংশোধনের পর তাদেরও ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তখন বকেয়া ভাতাও পাবেন তারা। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে এ পর্যন্ত ছয়বার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর পরও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি সারাদেশে ৪৯১টি উপজেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করে সরকার। যার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দেওয়া ভাষ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।

সূত্র : সমকাল
এন এইচ, ১৫ মার্চ

Back to top button