পরিবেশ

ইটভাটা যেভাবে কেড়ে নিল প্রবাহমান নদীর প্রাণ

পিনাকী রায় ও দীপঙ্কর রায়

খুলনা, ১৩ ফেব্রুয়ারি – খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার এক সময়ের প্রবাহমান নদী ভদ্রা এখন একটি সরু খালে পরিণত হয়েছে। এর জন্য দায়ী নদীর জমি দখলকারী ইটভাটাগুলো, যেগুলো চালাচ্ছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে নয়টি ইটভাটা চিহ্নিত করেছে খুলনার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বিডব্লিউডিবি)। এর মধ্যে খারনিয়া ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর তীরের চার কিলোমিটার দীর্ঘ জায়গা দখল করে রাখা ইটভাটাগুলোও রয়েছে। যে ইটভাটাগুলোর মালিকদের মধ্যে একজন সংসদ সদস্য (এমপি), উপজেলার ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও রয়েছেন।

বিডব্লিউডিবি খুলনার তালিকায় ভদ্রা ও হরি নদীর তীরবর্তী জায়গায় থাকা মোট ১৮টি ইটভাটার নাম রয়েছে।

বিডব্লিউডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ভদ্রার দুই পাড়ে এবং শোলমারী ও হরি নদীর তীরবর্তী নিচু জায়গায় আরও ইটভাটা স্থাপন করায় তালিকায় আরও নাম যোগ হবে।

কর্মকর্তারা আরও বলছেন, ইটভাটার মাধ্যমে এসব দখলের কারণে ভদ্রার শাখা নদী সালতাসহ সংযুক্ত অন্তত তিনটি খালের স্রোতের প্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন : ‘মরতে’ বসেছে প্রাণের শীতলক্ষ্যা

গত সপ্তাহে খারনিয়া ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের সংবাদদাতা দেখেছেন, এক সময় ৫০০ মিটার প্রশস্ত ভদ্রা নদী বর্তমানে সংকুচিত হয়ে ১৬-৩০ মিটার হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শীতে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর দুই পাড় থেকে দখলদাররা খননকারী যন্ত্র দিয়ে মাটি তুলছেন। তারা সেই মাটি ইট বানাতে ব্যবহার করেন।

খারনিয়া গ্রামের ইকবাল হোসেন জানান, তিনি শ্রমিকদের ব্যাগে ইট ভরে তা ইটভাটার সামনের অংশের নদীতে ফেলতে দেখেছেন। এভাবেই তারা নদীর অংশ ভরাট করে।

যদিও নদীর জমি দখল করা অপরাধমূলক কাজ, তা সত্ত্বেও দখলদাররা গত ১২ বছর ধরে এসব ইটভাটা চালিয়ে আসছে। ইটভাটা মালিকদের কাছে নোটিশ পাঠানো ছাড়া কার্যত আর তেমন কোনো ব্যবস্থাই এখনো পর্যন্ত নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী, সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি, কৃষি জমি ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় ভাটা স্থাপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ।

তালিকায় থাকা ভাটাগুলোর মধ্যে একটি কেপিবি (কলাপদ) ব্রিকস, যেটি ভদ্রা নদীর বাম পাশের তীরের ১৭৫ মিটার জায়গাজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে। খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনের এমপি এবং সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ স্বীকার করেছেন যে, তিনি ওই ইটভাটার মালিক। কিন্তু, নদীর জমি দখল করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তিনি।

ডুমুরিয়া উপজেলা ইটভাটা মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও নারায়ন চন্দ্র চন্দ। গতকাল তিনি বলেন, ‘আমি এই জমিটি দখল করিনি।’

‘যখন চরের এই জমিটি জেগে ওঠে, তখন ডিসি অফিস কর্তৃক তা ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এবং আমরা তাদের (ভূমিহীন) কাছ থেকে এটি ইজারা নিয়েছি। সরকার যদি নদী খনন করার কোনো ব্যবস্থা নেবে, তখন আমরা ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দেবো এবং সরকারের কাছে জমি সমর্পণ করব।’

খুলনা বিডব্লিউডিবির তালিকা অনুযায়ী নদী জমি দখল করা আরেকটি ইটভাটার নাম সেতু ব্রিকস, যেটির মালিক ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আজাজ আহমেদ। অন্য আরও একটি ইটভাটার নাম কেবি ব্রিকস, যেটির মালিক ডুমুরিয়া সদরের ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুর কবির বুলু।

খুলনা বিডব্লিউডিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিদের মালিকানাধীন ইটভাটাগুলোর প্রত্যেকটি ভদ্রা নদীর ১৭৫-২৫০ মিটার জায়গা দখল করে আছে। আর গুতুদিয়া ইউনিয়নের চারটি ইটভাটাই শোলমারী নদীর ১৯০-২৫০ মিটার জায়গা দখল করে আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যানের মালিকানাধীন সেতু ব্রিকস হরি নদীর ২৩০ মিটার বিস্তৃত জায়গা দখল করে আছে। আর ইউপি চেয়ারম্যানের কেবি ব্রিকস ভদ্রা নদীর ২১০ মিটার বিস্তৃত জায়গা দখল করে আছে।

এ বিষয়ে জানতে কেবি ব্রিকসের মালিক ও ডুমুরিয়া সদরের ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বুলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ জমিই ১৫ বছর আগে স্থানীয় মালিকদের কাছ থেকে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই করে নেওয়া হয়েছে। আর কিছু অংশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন, যে অংশটুকু আমরা শুধু মাটি স্তূপ করে রাখার জন্য ব্যবহার করছি।’

পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সব ধরনের অনুমোদন নিয়েই ইটভাটার কার্যক্রম পরিচালনা করছি।’

ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আজাজ আহমেদ জানান, তিনি আইনের সব বিধি মেনেই সেতু ব্রিকস নামের ইটভাটাটি স্থাপন করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় জমিমালিকের কাছ থেকে জমিটি ইজারা নিয়েছি। আমার ইটভাটায় নদীর অংশের কোনো জমি নেই। নদী ভরাটের কাজেও আমি জড়িত নই।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে কোনো ধরনের নোটিশ পাননি বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কে বা কারা কোন প্রক্রিয়ায় এই তালিকা তৈরি করেছে, তা আমি জানি না।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার ব্যবস্থাপনা ও রক্ষাণাবেক্ষণ বিভাগ-১’র নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, ‘তালিকায় থাকা ইটভাটাগুলো ধীরে ধীরে নদীগুলোকে হত্যা করছে।’

‘শুধু এই ১৮টি ইটভাটাই নয়, নদী দখলদারদের তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়’, বলেন তিনি।

ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল ওয়াদুদ বলেন, উপজেলায় থাকা ৩৭টি ইটভাটার মধ্যে ১৮টিই নদীর তীরবর্তী স্থানে স্থাপন করা হয়েছে, যেগুলোর তালিকা করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি তাদের সবার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চেয়েছিলাম এবং এখন আমি সেগুলো যাচাই করছি। এই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দ্রুতই উচ্ছেদ অভিযান চালানো শুরু হবে।’

‘আমি নিশ্চিত যে, এই ইটভাটাগুলোর প্রত্যেকটিই নদীর জমি দখল করে আছে’, যোগ করেন তিনি।

আটলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতাপ কুমার রায় জানান, তার ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর তীরের জায়গায় ১১টি ইটভাটা রয়েছে। যেগুলোর কারণে পরিবেশ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

তিনি বলেন, এর মধ্যে দুইটি ইটভাটা নদীর স্বাভাবিক স্রোত প্রবাহকে উপেক্ষা করে আগ্রাসীভাবে নদীর জমি দখল করে কার্যক্রম চালাচ্ছে। সেই দুইটি ইটভাটা খারনিয়া ব্রিজের পাশেই অবস্থিত।

খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সাইফুর রহমান খান বলেন, ‘কোন ইটভাটাগুলো ভদ্রা বা হরি নদীর জমি দখল করে স্থাপন করা হয়েছে এবং পরিবেশের ক্ষতি করছে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।’

‘আমরা নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র দেই। কিন্তু, জেলা প্রশাসন সার্বিক কার্যক্রমের দেখাশোনা করে থাকে এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালনা করে থাকে’, বলেন তিনি।

জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় ১৫৩টি ইটভাটা রয়েছে।

ডিসি অফিসের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতি বছর ইটভাটাগুলোর নিবন্ধন পুনরায় নবায়ন করার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় বেশিরভাগ ইটভাটাই নবায়ন ছাড়াই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

সূত্র : দ্য ডেইলিস্টার
এন এইচ, ১৩ ফেব্রুয়ারি

Back to top button