পরিবেশ

‘মরতে’ বসেছে প্রাণের শীতলক্ষ্যা

রাজু আহমেদ

নারায়ণগঞ্জ, ১০ ফেব্রুয়ারি – এই নদীকে ঘিরেই গোড়াপত্তন হয়েছিল প্রাচ্যের ডান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জ নগরীর। এককালে দূর-দূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ী জাহাজে খাবারের পানি নেয়া হতো এই নদী থেকেই।

আশপাশের শত গ্রামের মানুষের কাছেও এই নদীর পানি ছিল পান করার উপযোগী। সেই নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা নদী এখন মরতে বসেছে দূষণ আর দখলের কবলে। এককালের সুপেয় পানি যেন এখন অনেকটাই বিষ। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য স্থানে ভ্রমণের অন্যতম পথ ছিল নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর।

নারায়ণগঞ্জকে তাই বাংলা ভ্রমণের প্রবেশদ্বার বলা হতো। এখনও এই নদীর উপর নির্ভর করে আছে কয়েক লাখ মানুষ। কিন্তু সেই স্বচ্ছ স্রোতস্বিনী নদীর পানি এখন ভরা বর্ষায় কিছুটা পরিষ্কার থাকলেও বছরের বাকি সময়ে কালচে আর পুঁতিগন্ধময়। মাছ ধরা তো দূরে থাক, দূষণের কারণে সুস্বাদু মাছ এখন শুধুই অতীত রোমন্থন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, শীতলক্ষ্যার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য নদী দূষণের প্রধান কারণ। নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, সেখানে জলজ প্রাণের অস্তিত্ব এখন মারাত্মক সংকটে।

সরেজমিন দেখা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারের শীত মৌসুমেও শীতলক্ষ্যার কালো পানি আরো বেশি প্রগাঢ় হয়ে অনেকটা আলকাতরার রূপ নিয়েছে। তার সঙ্গে বেড়েছে উৎকট গন্ধ আর সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক ফেনিল ঢেউ।

আরও পড়ুন : ফেসবুকে রাষ্ট্রের ব্যাপারে অসত্য তথ্য দিলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রস্তাব

নারায়ণগঞ্জ সেন্ট্রাল খেয়াঘাট থেকে একটু উত্তরে গেলেই চোখের পড়বে একের পর এক ড্রেনের মুখ; যেগুলো শহর ও শহরতলীর ড্রেনগুলোর সাথে যুক্ত। শহরের খানপুর বরফকল মাঠ এলাকায় গিয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়।

সন্ধ্যার পর পাঁচটি মোটা পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন ডাইংয়ের দূষিত পানি নদীতে গিয়ে পড়ে। কারণ ডাইং কারখানাগুলো বর্জ্য ও দূষিত পানি ছেড়ে দেয়। এছাড়া অনেক ডাইং কারখানা বর্জ্য ফেলার পাইপগুলো পানির নিচ দিয়ে নিয়েছে; যাতে সেগুলো দৃশ্যমান না হয়।

পরিবশে অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, শীতলক্ষ্যার দুই পারে দুই হাজারেরও বেশি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। আর এর মধ্যে তরল বর্জ্যে নির্গমনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে শিল্প-কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে ৪০৭টি প্রতিষ্ঠানের। তবে ব্যবহার করছে ৩০১টি প্রতিষ্ঠান।

একদিকে দূষণ ও অন্যদিকে দখলের কবলে প্রতিনিয়ত তার জৌলুস হারাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা। নদীর দুইপাশ ডকইয়ার্ড, গোডাউন, কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনার দখলে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে।

শীতলক্ষ্যা নদীর বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল- নোংরা কালো রঙের পানিতে গোসল করছেন লোকজন। কেউ কেউ কাপড় ধোয়ার কাজটিও সারেন এই পানিতেই। ফলে চুলকানি রোগটি এখানে স্বাভাবিক।

এলাকার প্রবীণরা বলেন, এক সময় রোগ হলে শীতলক্ষ্যায় গোসল করাইতো। আর এখন এই পানিতে আজ গোসল করলে কালই বিভিন্ন রোগে ভুগতে হইবো।

তারা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আগে এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন অনেকে। কিন্তু ১৫-২০ বছর ধরে কেউই নদীতে মাছ ধরে না। নদীর যে অবস্থা তাতে মাছ থাকা অসম্ভব।

এদিকে কর্মব্যস্ত শহরে প্রতিদিন নৌকায় করে নদী পাড়ি দিতে হয় হাজার হাজার মানুষকে। দুইপাড়ের কর্মজীবী মানুষ দুইবেলা নদী পাড়ি দেন নাক চেপে।

তারা বলছেন, কী আর করার। জীবিকার তাগিদেই আমাদের নদী পার হতে হয়। দুর্গন্ধের কারণে দম বন্ধ হয়ে আসে। নাকে কাপড় কিংবা রুমাল ধরে দুইবেলা পার হই।

পরিবেশ আন্দোলন ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এবি সিদ্দিক জানান, শীতলক্ষ্যা নারায়ণগঞ্জের প্রাণ। কিন্তু বর্জ্য ও দখলের শিকার হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যা। নদী রক্ষার আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে শীতলক্ষ্যা এখন অস্তিত্ব সংকটে। নদীর দুই পাড় দখল করে নদীকে লম্বা খাল বানিয়ে দিচ্ছে।

নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. মঈনুল হক জানান, শীতলক্ষ্যা দূষণের অন্যতম কারণ শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। সব শিল্প-কারখানায় ইটিপি নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে তার অধিকাংশই ব্যবহার করে না। এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের জন্য আমাদের জনবল খুব কম। এছাড়াও মোবাইল কোর্টের জন্য আমাদের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট নেই। ঢাকা থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আসলে তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, নদী রক্ষায় বিভিন্ন অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে।

সূত্র : যুগান্তর
এন এ/ ১০ ফেব্রুয়ারি

Back to top button