জাতীয়

দেশে ভেজাল মদের ছড়াছড়ির কারণ

হাসান আল জাভেদ

ঢাকা, ০৩ ফেব্রুয়ারি – মহুয়া বীজের নির্যাসসহ স্থানীয় বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি মদ পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছে খুবই প্রিয়। পার্বত্যাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর এমন চোলাই মদ তৈরি ও পানে দৃশ্যমান কোনো বাধানিষেধ নেই। পরিমাণে কম হলেও এসব মদ ছড়িয়ে পড়ছে সমতল অঞ্চলে। কিন্তু পাহাড়ের চোলাই মদ বলে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব মদ বিক্রি হচ্ছে, তার অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে বাঙালিদের তৈরি ভেজাল মদ। এসব ভেজাল ও বিষাক্ত মদ পান করে মারা যাচ্ছে অনেকে। সম্প্রতি এটি অনেক বেড়ে গেছে।

দেশে কেন ভেজাল মদের ছড়াছড়ি? এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিদেশি মদ আমদানি করোনার কারণে কমে গেছে। শুল্ক ফাঁকি দেওয়া মদের বিরুদ্ধেও প্রায়ই চলে অভিযান। কিন্তু মদের চাহিদা কমেনি। তাই একশ্রেণির অর্থলোভী চক্র ভেজাল মদ তৈরির কারখানা গড়ে তুলছে। তারা বিদেশি এক বোতল মদ থেকে নানা ভেজাল মিশিয়ে তৈরি করছে একাধিক বোতল মদ। এ ছাড়া চোলাই মদ উৎপাদনকারীরা ইথাইলের পরিবর্তে বেশি লাভের জন্য মিথাইল ব্যবহার করছে। এভাবেই দেদার বিক্রি হচ্ছে ভেজাল মদ; মরছে

পানকারীরা। এসবের বিরুদ্ধে একদিকে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না; অন্যদিকে দু-একজন ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে ভেজাল মদ উৎপাদনকারীদের নিরুৎসাহিত করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন ভেজাল মদের ছড়াছড়ি।

আরও পড়ুন : এক মাসে ৫৭ হাজার টন বর্জ্য-মাটি অপসারণ করা হয়েছে

মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাতের মাড়, তালের রস, খেজুররস পাচন-গাঁজনের মাধ্যমে তৈরি চোলাই মদকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভেজাল মদ কারখানা। এক সময়ের চোলাই ও বাংলা মদ উৎপাদনকারীরাই অ্যালকোহল হিসেবে এখন ইথাইলের পরিবর্তে মিথাইল ব্যবহার করছে। মদ তৈরিতে ফার্নিচারের বার্নিশে ব্যবহৃত স্পিরিট, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে বিক্রি করা রেক্টিফায়েড স্পিরিট বা মিথাইল মেশানোর কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি এবং ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, মদের মধ্যে মেশানো অ্যালকোহলে নেশা হয়। এ নেশার জন্যই মানুষ মদ সেবন করে। অ্যালকোহল হচ্ছে ইথাইল নামের এক তরল রাসায়নিক। কিন্তু বাংলাদেশে ভেজাল মদ উৎপাদনকারীরা ইথাইলের পরিবর্তে কম দামের রেক্টিফায়েড স্পিরিট মেশাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলা মদ নামে যেটা তৈরি হয়, আগে তাতে ভেজাল মেশানো হতো। এখন সরাসরি বিদেশি দামি ব্র্যান্ডের একটি মদের বোতল খুলে কয়েকটি বোতল তৈরি করা হচ্ছে। এমন ভেজাল মদ তৈরির সময় রেক্টিফায়েড স্পিরিট মেশানোর ফলে নেশা হওয়ার পাশাপাশি মূল বোতলের দামি মদের ঘ্রাণও থেকে যায়। সেবনকারীরা এটা না বুঝেই গ্রহণ করেন। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এ ধরনের ভেজাল মদ তৈরি ও সরবরাহ রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি মদে ইথানলের পরিবর্তে মিথানল ব্যবহার করায় পাকস্থলী দ্রুত বিষাক্ত হয়ে যায়। এ কারণেই মদপানকারীদের মৃত্যু হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে মদ তৈরিতে দুটি প্রতিষ্ঠানের সরকারি অনুমোদন রয়েছে। এর মধ্যে একটি দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনি কারখানা ও ডিস্টিলারি, অন্যটি যমুনা ডিস্টিলারি। এর বাইরে পুরান ঢাকার মুরগিটোলা, মেথরপট্টি, ঠাটারিবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, কেরানীগঞ্জ এলাকায় মদ তৈরির অনেক অবৈধ কারখানা রয়েছে।

আরও পড়ুন : মুজিববর্ষে অধিক মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ প্রধান বিচারপতির

বেশ কয়েকজন মদপানকারীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের পর দেশে বিদেশি মদের আমদানি ও বিক্রি কমে গেছে। অন্যদিকে মদ তৈরির স্থানীয় কারখানাগুলো স্যানিটাইজারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এতে বাজারে মদের সরবরাহ কমে গেছে। আর এ সুযোগে ভেজাল মদ তৈরি করে দেদার বিক্রি করছে অসাধু চক্র।

বাংলাদেশে বিয়ার ও মদ আমদানি করতে সাড়ে ৪০০ শতাংশ কর দিতে হয়। হুইস্কি বা ভদকার মতো কড়া পানীয় আমদানিতে শুল্ক ৬০০ শতাংশেরও বেশি। বিপুল পরিমাণ এই রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ওয়্যারহাউসগুলোও নানা কৌশলে এসব পানীয় বিক্রি করছে। গত কয়েক মাসে শুল্ক তদন্ত বিভাগের চলা অভিযানে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় রাজধানীর অনেক বার ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়। অভিযানের কারণে শুল্ক ফাঁকির বিদেশি মদ বিক্রি করে যাওয়ায় সুযোগ বুঝে অর্থলোভী কিছু চক্র সরবরাহ করছে ভেজাল মদ।

গত সোমবার রাজধানীর তেজগাঁও ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভেজাল মদ তৈরিতে জড়িত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পুলিশ বলছে, গত কয়েক দিনে যারা ভেজাল মদ সেবনে মারা গেছেন, তারা এসব মদ সেবন করেছিলেন।

অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বলেন, এ চক্রের মূল হোতা নাসির দীর্ঘদিন ধরে মদ বিক্রি করে আসছিল। তারা একটি মদের বোতল খুলে দু-তিন বোতল মদ তৈরি করত। সম্প্রতি ওয়্যারহাউসগুলোয় মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় তারা নকল মদ তৈরির কারখানা গড়ে তোলে। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের আশপাশ এলাকা থেকে স্পিরিট, স্টিকার, রঙ সংগ্রহ করে, চিনি পোড়ানো কালার ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে নকল মদ তৈরি করে। রুশ, স্কটিশ, সুইডিশ ও ইংলিশ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের নাম দিয়ে স্পিরিট ও রঙ দিয়ে তৈরি এ বিষাক্ত মদের কারখানার চিফ কেমিস্ট জাহাঙ্গীর আলম। যিনি একসময় ভাঙারির দোকানের কর্মচারী ছিলেন। রাজধানীতে এমন আর কয়টি চক্র আছে, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে, জানান মশিউর রহমান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আইন অনুযায়ী, চোলাই মদ বা বাংলা মদ সি-ক্যাটাগরির মাদক। এতে সেবনকারীদের প্রথমত আদালতের মাধ্যমে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এর পরও সেবনকারী সংশোধন না হলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী, বহনকারী, গুদামজাতকারীদের বিরুদ্ধে ওজন ভেদে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও চোলাই বা বাংলা মদ জব্দ, সেবনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার রেওয়াজ খুবই কম।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা ও অপারেশন) মো. মোসাদ্দেক হোসেন রেজা বলেন, ভাতের মাড়, তালের রস, খেজুরের রসের পচন, গাঁজন করে এক ধরনের চোলাই মদ তৈরি করা হয়। এই পচনের ফলে এক ধরনের ইথাইল অ্যালকোহল তৈরি হয়। এতে ধীরে ধীরে লিভার, কিডনি নষ্ট হলেও দ্রুত মৃত্যুর কারণ হয় না। তবে ভেজাল মদে দ্রুত মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ভেজাল মদ তৈরির কারখানার বিরুদ্ধে অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত রয়েছে, জানান তিনি।

সূত্র: আমাদের সময়
এন এ/ ০৩ ফেব্রুয়ারি

Back to top button