জাতীয়

রেল কলোনিতে ভাড়া বাণিজ্য

সজিব ঘোষ

ঢাকা, ০১ ফেব্রুয়ারি – রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশনের আশপাশে রেলের ৫৮ একর জমির মধ্যে অন্তত ১১ একর বেদখল হয়ে গেছে। এসব জমিতে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড, বস্তি, বহুতল আবাসিক ভবন, ক্লাবের কার্যালয় ও মাঠ, ফলের আড়ত। রয়েছে মসজিদ, বিদ্যালয়, মাদরাসা ও মন্দির। অবৈধভাবে দখল করা জমি থেকে প্রতি মাসে অন্তত ৭৫ লাখ টাকা আয় করছে দখলদাররা। অথচ তেজগাঁও রেলস্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূ-সম্পত্তি থেকে মাসে আয় হয় মাত্র এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্টেশনের পূর্ব পাশে গড়ে ওঠা ট্রাকস্ট্যান্ডের দখলে আছে সবচেয়ে বেশি জমি। এখানে রেলের জমির পরিমাণ পাঁচ একরের বেশি। এখান থেকে দখলদাররা প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে।

এর পরই সবচেয়ে বেশি জমি দখল করে গড়ে উঠেছে পাঁচ-ছয়টি বস্তি। এসব বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এসব বস্তি থেকে ভাড়া হিসেবে নিয়ন্ত্রণকারীরা তুলে নিচ্ছেন মাসে প্রায় ৯ লাখ টাকা।

স্টেশনের উত্তর পাশের কালামগাঁও হিসেবে পরিচিত আবাসিক এলাকায় রেলের এক একরের বেশি জমি দখল হয়ে গেছে। এখানে দখলদারির অভিযোগ স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে। এই জমির কিছু বিক্রি হয়ে গেছে, কিছু জমির ওপর ভবন উঠেছে, যেখান থেকে ভাড়া ওঠে মাসে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা।

রেলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ক্লাব কার্যালয় ও মাঠ। ক্লাবের দখল করা জায়গায় রয়েছে বস্তি ও দোকানপাট। এর আয়ও নিচ্ছে ক্লাব, যার পরিমাণ মাসে অন্তত পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়া স্টেশনে যাওয়ার রাস্তার পাশেই অস্থায়ী ফলের আড়ত তৈরি হয়েছে। এসব আড়ত থেকে টাকা তোলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। এর পরিমাণও মাসে আট-দশ লাখ টাকা।

আরও পড়ুন : কারাগার থেকে আদালতে আসা–যাওয়া করেন মাইক্রোবাসে

রেলের জমি দখলের বিষয়ে রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ বলছে, বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে তারা চেষ্টা করছে। কিন্তু স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ প্রভাবশালীদের চাপে তারা শতভাগ সফল হতে পারছে না।

রেলের জমিতে ট্রাকস্ট্যান্ড থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলের জায়গা সময়মতো রেল নিয়ে নেবে। তেজগাঁও স্টেশন নিয়ে আমাদের ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। তা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। তখন এই জায়গাগুলো আমাদের দরকার হবে।’

দখলদাররা ট্রাকস্ট্যান্ড ইজারা দিচ্ছে, রেল নিজে ইজারা দিয়ে রাজস্ব বাড়াচ্ছে না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘রেলের জমি দখল করে অন্যদের ইজারা দেওয়া অবৈধ।’

কালামগাঁওয়ে রেলের জমি দখল ও কেনাবেচার বিষয়ে নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘কোনো বুদ্ধিমান লোক রেলের জমি কিনবে না। দখলের দিন শেষ। রেলের সব জমি আমরা উদ্ধার করে নেব।’

বস্তির প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু বস্তি উচ্ছেদ করলেই হবে না, সেই জায়গাকে রেলের কাজে ব্যবহারও করতে হবে। তাই আমাদের পরিকল্পনা চলছে। উচ্ছেদ কার্যক্রমও অব্যাহত রয়েছে।’

ট্রাকস্ট্যান্ড : তেজগাঁও রেলস্টেশনের প্রায় পাঁচ একর ১০ শতাংশ জমি দখল করে গড়ে উঠেছে ট্রাকস্ট্যান্ড ও মেরামতের দোকান। স্বাধীনতার পরপর এখানে ট্রাকস্ট্যান্ড গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তেজগাঁও সাতরাস্তার মোড়ের দিকে সম্প্রসারিত হয়। বছর কয়েক আগে সিটি করপোরেশন মোড়ের ওই ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছে। কিন্তু রেলের জায়গায় গড়ে ওঠা ট্রাকস্ট্যান্ড এখনো রয়ে গেছে। মালিক ও শ্রমিকদের তিনটি সংগঠন এই ট্রাকস্ট্যান্ড পরিচালনা করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই স্ট্যান্ডে ছোট-বড় মিলিয়ে ট্রাক রাখা যায় প্রায় এক হাজার ২০০টি। এখানে এক দিন ট্রাক রাখলে দিতে হয় ১৪০ টাকা, যেটাকে তারা চাঁদা বলছে। সেই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৭০০ ট্রাক থাকলে মাসে ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। সঙ্গে ট্রাকস্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেরামতের দোকান ও মার্কেটের দোকান ভাড়া তো আছেই।

স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকারী সংগঠনের অন্যতম বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও এখানে। সমিতি সূত্রের দাবি, টাকার অঙ্ক আসলে এত বেশি নয়। ওই সূত্রের দাবি অনুযায়ীও হিসাব করলের মাসে চাঁদা ওঠে প্রায় ২০ লাখ টাকা।

সূত্রটি জানায়, তিন বছর ধরে ট্রাকস্ট্যান্ড ইজারা দেওয়া হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে কেউ কেউ ইজারা নিয়ে স্ট্যান্ড পরিচালনা করছেন।

স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকারী আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল কাসেম বলেন, প্রতি মাসে তিন লাখ টাকায় ট্রাকস্ট্যান্ড ইজারা দেওয়া হয়েছে। এই তিন লাখ টাকা ভাগ হয় নিয়ন্ত্রণকারী তিন সংগঠনের মধ্যে। এর মধ্যে ড্রাইভার্স ইউনিয়ন পায় ৩৬ শতাংশ, মালিক সমিতি পায় ৩২ শতাংশ ও বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতি পায় ৩২ শতাংশ টাকা।

আবুল কাসেম তেজগাঁও থানা শাখা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি। জমির মালিক হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষকে কোনো টাকা দেওয়া হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই টাকার সঙ্গে রেলের কোনো সমপর্ক নাই।’ রেলের জমি দখলের বিষয়ে কাসেম বলেন, ‘জমি রেলের এটা আমরা অস্বীকার করছি না। রেল যেদিন চাইবে সেদিনই আমরা জায়গা তাদের বুঝিয়ে দেব। তবে তার আগে ট্রাকস্ট্যান্ডের জন্য আমাদের জায়গা বুঝিয়ে দিতে হবে।’

কালামগাঁও : ট্রাকস্ট্যান্ডের ওপর দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে একটি মাঝারি ধরনের আবাসিক এলাকা। স্থানীয় লোকজন চেনে কালামগাঁও নামে। উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কালাম হাজির নামে এলাকাটির নাম হয়ে গেছে।

রেলের দাবি, আওয়ামী লীগ নেতা কালামের নেতৃত্বে রেলের এক একর ১৫ শতাংশ জমি দখল করা হয়েছে। তিনি নিজের জমি বলে অনেক জমি বিক্রি করেছেন, এখনো করছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কথিত দখলি জমিতে ১৭টি প্লটে একতলা থেকে শুরু করে বহুতল আবাসিক ভবন রয়েছে।

জানা গেছে, ২০ বছর আগে যখন সিটি জরিপ হয়, তখন ওই জমি বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। রেকর্ড সংশোধনের জন্য রেল কোনো আপিল করেনি। তবে জমির মালিকানা নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে একটি মামলা বিচারাধীন। হাইকোর্ট স্থিতাবস্থার আদেশ দেওয়ায় রেল দখলদারদের উচ্ছেদও করতে পারছে না।

কালাম হাজির পক্ষের আইনজীবী সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘এই জমির বিরোধ নিয়ে করা মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে। আদালতের রায় অনুযায়ী, বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত রেল কর্তৃপক্ষ এই জমির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে বা সরে যাওয়ার নোটিশ দিতে পারবে না।’

আওয়ামী লীগ নেতা কালাম বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ এই জায়গায় বসবাস করত। আমরাও সেই সূত্রে বসবাস করছি। জায়গার কাগজপত্র সবই আমাদের আছে। আমরা খাজনা, গ্যাস, বিদ্যুতের বিল দিই। বাড়ির সামনে দিয়ে সিটি করপোরেশনের রাস্তা গেছে। জায়গা যদি রেলের হয় তাইলে এত সুবিধা আমরা কেমনে পাই।’

রেললাইন ও রেল কলোনির আশপাশে বস্তি : রেললাইনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছোটখাটো একাধিক বস্তি। এসব বস্তির ঘরভাড়া বাবদ কোনো টাকা রেল পায় না। এসব বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালীরা। তাঁদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। বস্তির প্রতিটি ঘর থেকে মাসে গড়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করে ভাড়া তোলা হয়। এ ছাড়া রেললাইন থেকে কিছুটা দূরে রেলের জমিতে থাকা কফিক্ষেত বস্তি, বেবির গ্যারেজ, কয়েকটি রিকশার গ্যারেজ এবং ৫০টির বেশি দোকান মিলিয়ে মাসে চার-ছয় লাখ টাকা লুটে নিচ্ছে দখলদাররা। ২৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও মহিলা যুবলীগের নেতাকর্মীরা বস্তি ও এর আশপাশের দোকানপাট, গ্যারেজ নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁদের সঙ্গে রেলের কোনো কোনো কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে।

গত ২৮ ডিসেম্বর রেললাইন ঘেঁষে পূর্ব পাশের একটি বস্তির কিছু ঘর ভেঙে দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। বস্তির বাসিন্দারা বলছে, ভাড়ার নামে তোলা এই টাকার ভাগবাটোয়ারায় রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাদের ঘর ভাঙা পড়েছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তারা বলে, তাহলে অন্য বস্তিগুলো ভাঙা হলো না কেন?

জানতে চাইলে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘রেললাইনের আশপাশের বস্তির টাকা কারা তোলে তা আমার জানা নেই। তবে এর সঙ্গে যুবলীগ বা ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকলে তা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়, মূল দলের কোনো সম্পর্ক নেই।’

ফলের আড়ত : স্টেশনের দিকে যেতে রাস্তার পাশে অস্থায়ী স্থাপনায় বসানো ফলের আড়তের বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর ইউনিটের সভাপতি জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহযোগী মাসুম। অবশ্য জাহাঙ্গীরের দাবি, ফলের আড়তের টাকা তিনি নেন না। তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদ কমপ্লেক্স কমিটির মাধ্যমে মসজিদের কাজে ব্যয় করা হয়।

খেলাঘর ক্লাব : তেজগাঁও রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে রেল কলোনির ভেতর দিয়ে গেলে খেলাঘর ক্লাবের কার্যালয় ও মাঠ। এই ক্লাবের দখলে রেলের প্রায় এক একর ৫ শতাংশ জমি। এই ক্লাবের কার্যালয় ও মাঠ ঘিরে প্রায় ৩০০ ঘরের বস্তি ও বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। বস্তির ঘরের ভাড়া ক্লাব নেয় না দাবি করে ক্লাবের সিনিয়র সভাপতি মো. আবুল আলম চাঁদ বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা।’ তাহলে কারা নেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আপনি খুঁজে নেন। আমি কারো নাম বলতে যাব না।’

আলম চাঁদ বলেন, ‘চারপাশের এত টাকা তুললে প্রতিবছর দেনায় থাকতাম না। আমরা এ বছরও ঘাটতিতে আছি। তবে আমাদের ক্লাবের জায়গায় কিছু দোকান আছে, যা ভাড়া দিয়ে বছরে সাত লাখ টাকার মতো পাই।’

স্টেশন ও ভূ-সম্পত্তি থেকে রেলের আয় : তেজগাঁও রেলস্টেশন থেকে রেলওয়ে আয় করে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যার মধ্যে ৫০ লাখ টাকাই আসে পণ্য পরিবহন ও পার্সেল থেকে। আর দোকানভাড়া থেকে বছরে পাওয়া যায় ১০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয় মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। স্টেশনের ভূ-সম্পত্তি থেকে মাসে আয় হয় এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা। জমি ইজারার মাধ্যমে এই টাকা আয় হয়।

স্টেশনের চারপাশের রেলের জায়গা দখল করে অন্যরা লুটেপুটে খাচ্ছে—এমন অবস্থা সম্পর্কে স্টেশন মাস্টার আব্দুল আজিজ বলেন, ‘এসবের কোনো কিছুতেই স্টেশনের হাত নেই। সব কিছু লোকালদের হাতে। আমাদের কিছু বলার সুযোগ নাই। তবে মসজিদ কমিটির সভাপতি হিসেবে আমি যত দূর জানি, মসজিদের জায়গাটি রেল থেকে ইজারা নেওয়া।’

সূত্র : কালের কন্ঠ
এন এইচ, ০১ ফেব্রুয়ারি

Back to top button