মালয়েশিয়ার রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি রাজ্যের নাম সেলাঙ্গর। সমৃদ্ধ, পরিচ্ছন্ন এবং কর্মব্যস্ত একটি অঞ্চল। এই রাজ্যে যেসব শহর আছে, তাদের মধ্যে পুচং যেন প্রবাসীদের এক নীরব মঞ্চ। এখানে সকালগুলো শুরু হয় নির্মাণসাইটে হেলমেট মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো শ্রমিকের ঘর্মাক্ত মুখে, আর রাত শেষ হয় ছোট ছোট হোটেলের ঘরে নিঃসঙ্গ নিদ্রায়।
পুচংয়ের তামান মাওয়ার এলাকা—যেখানে একদিকে চকচকে সুপারশপ, অন্যদিকে বাজেট হোটেল আর পুরনো কাঠের টংঘর। সেই শহরের একপাশে একটা হোটেল আছে—হোটেল মাজিদা ইন। এর রুম নম্বর ১২৩-তে এক সন্ধ্যায় পড়ে ছিল রক্তমাখা নিথর দেহ—এক ইন্দোনেশিয়ান নারীর।
প্রবাসে অভিবাসী জীবন নিঃসন্দেহে কঠিন। শিমুল বাবু, বাংলাদেশের এক অজপাড়া গ্রামের ছেলে, ২৩ বছর বয়সে মালয়েশিয়ায় এসেছিলেন ভাগ্য বদলাতে। ভিসার মেয়াদ, দালালের প্রতারণা, হোস্টেলের গাদাগাদি জীবন পেরিয়ে অবশেষে কাজ পেয়েছিলেন পুত্রজায়ার প্রেসিন্ট ২০ তে একটি নির্মাণসাইটে।
শিমুল একটু চুপচাপ ধরনের যুবক। কিন্তু চোখে ছিল ভালবাসার ক্ষুধা। কাজের ফাঁকে পরিচয় হয়েছিল এক হোটেল হেল্পারের সঙ্গে—যিনি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার এক দ্বীপ থেকে আসা নারী, বয়স ৩৯, ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা ছিল শুধু “মায়া”। আসল নাম নুরহিদায়াতি ।
শুরুতে কথাবার্তা, তারপর দেখা, তারপর ঘনিষ্ঠতা। কাজ শেষে তারা একসাথে ঘুরে। তাদের সম্পর্ক নিয়ে কেউ মুখ খোলেনি, তবে হোটেল কর্মীদের ফিসফাসে তাদের ঘনিষ্ঠতার গল্পটি ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাদের দেখা হতো শুক্রবারে, কখনও হোটেলের ছাদে, কখনও কাছাকাছি একটি চা দোকানে। মায়ার হাসি ছিল সহজ, কিন্তু চোখে ছিল কিছু লুকানো অভিমান। একদিন বলেছিল, “তুমি আমাকে বিয়ে করবে?” শিমুল হেসেছিল। কাঁচা বাংলায় বলেছিল, “তুমি আমার স্বপ্ন। কিন্তু এদেশে এখনও আমার কাগজ-পত্র ঠিক করতে পারি নাই।” মায়া চুপ করেছিল।
সময় গড়িয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাদের বন্ধুত্বের গায়ে জমতে থাকে খুঁতখুঁতে দাগ—অভিমান, সন্দেহ, অস্থিরতা। হোটেলে কাজ করতে করতে মায়া অনেকের সঙ্গে মিশত, হাসত, কাজ করত। শিমুলের মনে হতে লাগল—এই হাসি তার একার নয়।
শুরু হয় অবিশ্বাস। শিমুল কাজ থেকে ফিরে ফোন করে মায়াকে না পেলে দমবন্ধ লাগে। হোয়াটসঅ্যাপে দেরি করে রিপ্লাই এলে বুকে একটা উত্তেজনা অনুভব করে।
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪। বছরের শেষ রাত। তামান মাওয়ার জুড়ে উৎসবের আলো। হোটেল মাজিদার লবিতে বাজছিল নতুন বছরের কাউন্টডাউন সঙ। কিন্তু রুম নম্বর ১২৩–এর ভেতরে সময় জমে ছিল, থমকে ছিল।সেই রুমেই শেষবার দেখা হয় শিমুল আর মায়ার।
হোটেলের কর্মীরা পরে জানিয়েছিল—রাত দশটার একটু আগেই একটি জোড়া পা ধীরে ধীরে উঠে যায় দ্বিতীয় তলার করিডোর বেয়ে। তারপর এক দীর্ঘ নীরবতা।
দশটা পনেরো মিনিটে একজন ক্লিনার এসে রক্তমাখা দরজার নিচে ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়া কিছু দেখে চমকে যান। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। পুলিশ আসে, দরজা ভেঙে ঢোকে। বিছানার পাশেই পড়ে ছিল মায়ার নিথর দেহ। গলায় চাপের দাগ, হাতে নখের আঁচড়, চোখ খোলা—শুধু প্রাণ ছিল না।
আসে অ্যাম্বুলেন্স, আসে মিডিয়া। করিডোরে কৌতূহলী চোখ, নিচে জমায়েত জনতা। সেরডাং থানার পুলিশপ্রধান এএ আনবালাগান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “মৃত নারীর দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন আছে। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়—এটি হত্যাকাণ্ড।”
হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাত সাড়ে নয়টার দিকে রুমে ঢুকেছিলেন এক তরুণ, হালকা গড়নের, পরনে ধুলা-মাখা প্যান্ট আর মাথায় সেফটি হেলমেট। সে আর বের হয়নি।
চিত্র স্পষ্ট হতে শুরু করে। তদন্তের পর ৪ জানুয়ারি পুত্রজায়ার একটি নির্মাণ প্রকল্প থেকে শিমুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, “সে প্রথমে অস্বীকার করে, পরে স্বীকার করে— সে হত্যা করেছে মায়াকে।”
শিমুলের মুখে কোনো অনুশোচনা ছিল না, ছিল একধরনের স্তব্ধতা। যেন নিজের মধ্যেই নিজেকে আড়াল করেছে সে। পুলিশের গাড়িতে বসে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে। একটাও প্রশ্ন করেনি, একটাও উত্তর দেয়নি—শুধু বলেছিল, “সে আর আমার ছিল না।”
মামলা রুজু হয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায়, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সেরডাং কোর্টে তাকে তোলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট আমিরা সারিয়াতি জয়নালের সামনে অভিযোগপত্র পড়ে শোনানো হয়।
মায়ার মরদেহ পাঠানো হয় সেরডাং হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য। ডাক্তাররা নিশ্চিত করেন—মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল গলায় শ্বাসরোধের ফলে।
পুচং শহর থেমে যায়নি। কনস্ট্রাকশন সাইটে শোরগোল আগের মতই আছে, দোকানে চলছে বিকিকিনি, হোটেলের ঘরগুলো আবার ভাড়া যাচ্ছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। সবকিছু স্বাভাবিক।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়ে শিমুলের নাম। কেউ চিনত না তাকে খুব ভালো করে। ঘটনাটি জানার পর সবাই যার যার মতো করে মত দিতে থাকে।
ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিটিতে ছিল শোক আর ক্ষোভের ঢেউ। এক ইমাম জানাজা পড়িয়ে দেন, হোটেলের পাশের গোরস্থানে মায়াকে দাফন করা হয়।