সম্পাদকের পাতা

ইউরোপের পথে নিঃশেষ হওয়ার গল্প

নজরুল মিন্টো

ভূমধ্যসাগরের ঢেউগুলো যেন নিস্তব্ধতা চেনে না। তার নিরন্তর গর্জনে ডুবে যায় শত শত নাম, হারিয়ে যায় কতশত স্বপ্নের কণ্ঠস্বর। এই সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপারে ছিল অনেকের স্বপ্ন। একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

ইউরোপ মানে বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুনের কাছে এক দিগন্তজোড়া সম্ভাবনা। কেউ স্বপ্ন দেখে ইতালি, কেউ বার্সেলোনা, কেউ গ্রিস, কেউ জার্মানি। লিবিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়া এই অনির্দিষ্ট রুট, বাংলাদেশি তরুণদের কাছে হয়ে উঠেছে এক অনিবার্য আকর্ষণ—একদিকে স্বপ্ন, অন্যদিকে মৃত্যু।

ইউরোপে যাওয়ার এই পথের প্রতিটি ধাপে আছে লুকোনো খাঁজ—যেখানে চেপে বসে আছে এক ভয়াবহ মানবপাচার নেটওয়ার্ক। সাহারা মরুভূমির উত্তপ্ত বাতাস, ত্রিপোলির বন্দি শিবিরের অন্ধকার, কিংবা আজদাবিয়ার কোনো নামহীন কবর—এই পথের প্রতিটি বাঁকে ছড়িয়ে আছে একেকটি বাঙালি জীবনের শেষ অধ্যায়। IOM ও UNHCR অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে ১৩,০৪৪ বাংলাদেশি মারা গেছেন বা নিখোঁজ হয়েছেন।

সাধারণত যে রুটটি অনুসরণ করা হয় তা হলো: বাংলাদেশ থেকে দুবাই/মাস্কাট, সেখান থেকে মিশর, তারপর সাহারা পাড়ি দিয়ে লিবিয়ার ত্রিপোলি/মিজদাহ। সবশেষে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি।

এই রুটে যাওয়ার জন্য দালালরা দাবি করে ৭ থেকে ১২ লক্ষ টাকা। কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, কেউ গচ্ছিত স্বর্ণ বন্ধক রেখে দালালদের হাতে এই টাকা তুলে দেয়।

অনেকে মনে করে, ধার-দেনা করে হলেও ছেলে যদি বিদেশে গিয়ে আয় করে, সে দেনা মুছে যাবে দুই বছরে। বৈধ পথে যাওয়ার খরচ বেশি, কাগজপত্র জটিল, সময়সাপেক্ষ। তাই বিকল্প পথ খোঁজে তারা—যে পথ ধরে ঢুকে পড়ে পাচারকারীদের থাবায়।

দালালের পরিচয় ও অবস্থান
দালালদের কেউ ঢাকায় থাকে, কেউ থাকে মাল্টায়, কেউ লিবিয়ার বেনগাজিতে। তারা নিজেদের “ভিসা অফিসার” বলে পরিচয় দেয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, মানবপাচার চক্রের মূল হোতার নাম হাজী কামাল।  যিনি একাই লিবিয়ায় ৪০০ জনের বেশি মানুষ পাঠিয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ৪৫ জনের কোনো খোঁজ নেই। মানবপাচারকারীর অভিযোগে এই কামালকে একবার গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারেনি। কারণ অজানা। হাজী কামাল ঢাকায় ‘হজ্জ এজেন্সি’র মালিক হিসেবে পরিচিত। জানা যায়, তার মালিকানায় রয়েছে দুটি ক্যাম্প। এ হজ্জ এজেন্সির কার্যালয়ে প্রতিদিন আসে নতুন নতুন ক্লায়েন্ট। অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি কামালসহ অন্যান্য মানব পাচারকারীদের উৎসাহিত করছে।

পাচারের নেটওয়ার্ক ও কৌশল
গ্রামের দালাল, ঢাকার এজেন্ট, দুবাইয়ের ট্রানজিট হোস্ট, মিশর-লিবিয়ার সীমান্তজুড়ে মানবপাচারকারী, আর লিবিয়ার অভ্যন্তরে অস্ত্রধারী মিলিশিয়া। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার শূন্য অর্থনীতির ভেতরে এই মানবশিকারীরাই স্থাপন করেছে আধা-পেশাদার ক্যাম্প, যেখানে প্রতিদিন নতুন করে আটক হচ্ছে তরুণরা।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার দুই তরুণ হৃদয় ও রাসেল

লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর প্রায় ৭৫% অভিবাসী একাধিকবার অপহরণের শিকার হন। তাদের একত্র করে রেখে মোবাইলে ভিডিও তুলে পাঠানো হয় দেশে। কখনও দেখা যায়, যুবকটির শরীর রক্তাক্ত, কখনও সে চিৎকার করে কাঁদছে বিদ্যুতের শক খেয়ে। ভিডিওর শেষে থাকে দাবিঃ “১০ লাখ টাকা পাঠাও, না হলে মরদেহ ফেরত যাবে।”

অনেকে টাকা পাঠান, কিন্তু ছেলে ফেরে না। কেউ কেউ গুলি খেয়ে মারা যান, আবার কেউ মরে যান সাহারায় পানি না পেয়ে। মৃতদেহের খবর আসে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে, কখনো আসে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার দুই তরুণ হৃদয় ও রাসেল। তাদের পরিবার দালালদের হাতে ১৬ লাখ টাকা তুলে দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, ইতালিতে পৌঁছে তিন মাসেই টাকা ফেরত আসবে। লিবিয়ায় যাওয়ার পর ভিডিও আসে, “টাকা না দিলে বাঁচবে না।” টাকা পাঠানোর কয়েকদিন পর হোয়াটসঅ্যাপে আসে দুটি ছবি—রক্তমাখা দেহ, গুলিবিদ্ধ মুখ।

মাদারীপুরের আসাদুল। তার ভাইকে ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল—“ভাইরে, আমারে বিদ্যুৎ শক দিছে, তারা কয় টাকা না পাঠাইলে মাইরা ফেলবো।” পরিবার টাকা পাঠায়, কিন্তু ২৬ মে’র পর সে নিখোঁজ। ২৮ মে তার মরদেহ মেলে মিজদাহ ক্যাম্পে।

কুমিল্লার তরুণ মেহেদী জানায়, “আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে বের হয়েছিলাম। ওদের মধ্যে একজন এখনো সাহারায় আটকে আছে, আরেকজন মারা গেছে। আমি এখন ত্রিপোলির এক ক্যাম্পে বন্দি আছি।” তার ফোনে পাঠানো হোয়াটসঅ্যাপ অডিও ক্লিপে শুধু কান্নার শব্দ—“আমি মরে গেলে মা’রে কইয়েন ক্ষমা কইরা দিতে।”

২০২০ সালের মে মাসের শেষের দিকের এক রাতে ত্রিপোলি থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরের মিজদাহ শহরের উপকণ্ঠে একটি ধাতব গুদামে রাখা হয়েছিল ৪২ জন অভিবাসী। তাদের মধ্যে ৩৮ জন ছিলেন বাংলাদেশি। এই বন্দিদের জন্য আগেই পরিবার থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছিল। তারপরও মিলিশিয়া বাহিনী আবারও দাবি করে—আরও অর্থ চাই।

একজন বন্দি, যাকে সবাই ডাকতো সালেহ ভাই, হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে একজন অস্ত্রধারীর দিকে লাফিয়ে পড়ে। তার হাতে ছিল সিঁড়ির রড। সেই আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মিলিশিয়ার নেতা। চিৎকারে ছুটে আসে অন্যরা। পরবর্তী মিনিটগুলো যেন নরকের দৃশ্য। চারদিক থেকে শুরু হয় নির্বিচার গুলি।

এই গণহত্যায় মারা যায় ২৬ জন বাংলাদেশি। ১১ জনকে জীবিত উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় জিনতান হাসপাতালে। মৃতদেহগুলো গণকবরে দাফন করে রেড ক্রিসেন্ট।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ব্রেগা উপকূলে ২০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়, সবগুলো দেহ পচে যেতে শুরু করেছিল। সেগুলো আজদাবিয়া শহরের এক গণকবরে দাফন করা হয়। স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট ধারণা করে, তারা সবাই বাংলাদেশি।

এই গল্পের কোনও একক শিরোনাম নেই। কোনো একটিমাত্র মৃত্যুও আলাদা নয়। হতভাগ্য যুবকেরা শুধু একটা সুযোগ চেয়েছিল। সেই সুযোগ খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে গেল সাহারার মরুভূমিতে কিংবা ভূমধ্যসাগরের ঠাণ্ডা নীল জলে।

সাহারার মরুভূমি জানে—স্বপ্নের ওজন কত ভারী হয়। কত শত ছায়া আর কান্না তপ্ত বালির মধ্যে হারিয়ে গেছে, কত নাম হারিয়েছে দিগন্তের কিনারে, যাদের আর কোনোদিন খোঁজ মেলে না।

ভূমধ্যসাগরের ঢেউ জানে—সেই তরুণেরা একদিন এসেছিল স্বপ্ন নিয়ে, ফিরতে পারেনি—কেননা এই পথ ফেরার জন্য নয়, এই পথ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার জন্য।


Back to top button