ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি – হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকা-চালাতে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছেন আবু সিদ্দিক ওরফে গালকাটা সিদ্দিক। ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে গড়ে তুলেছেন অপরাধ সাজ্য। বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮টি মামলায় রয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তার ক্যাডার বাহিনীর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। নানা জায়গা বিচার দিয়েও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করানো সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার আশীর্বাদের ছায়াতলে রয়েছেন এ গালকাটা সিদ্দিক। প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য।
ওই কর্তাব্যক্তির কারণে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের পাত্তা দেন না সিদ্দিক। নিজের শ্বশুরের জায়গা দখল করে সাফায়েত নামে ডেইরি ফার্ম গড়ে তুলেছেন। এ খামার ঘিরে গড়ে উঠেছে রমরমা মাদকবাণিজ্য। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন শ্যালক।
সম্প্রতি ওই খামারের সামনে গেলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাপুলিশের একটি টিমের ওপর চড়াও হন সিদ্দিক। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ এসেছে প্রতিবেদকের হাতে। এতে দেখা যায়, সিদ্দিক পুলিশের এসআই মিজানুর রহমানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। বলছেন, ‘আগুন দিয়া পোড়াই দিমু সবার সামনে।’ একপর্যায়ে গালি দিতে থাকেন উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের। এ সময় সিদ্দিকের কোমরে ছিল পিস্তল। একই ধরনের আরও দুটি ভিডিওচিত্র এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
সরকারি খাস জমি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জমিও কেড়ে নিয়েছেন গালকাটা সিদ্দিক। এক হিন্দু ব্যক্তির জমি দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। নির্মাণ করেছেন তিনতলা আলিশান প্রাসাদ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া শহীদ মনসুর আলী খানের ভাতিজা মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য মোসলে উদ্দিনের ছেলে দুলাল খানের পরিবারকেও রেহাই দেয়নি সিদ্দিক বাহিনী। দুলাল খানের অপরাধ, সিদ্দিকের শ্যালকের করা মামলার সাক্ষী ছিলেন তিনি। তার সাক্ষীর কারণে সিদ্দিকের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যায়। এতে ক্ষিপ্ত হন সিদ্দিক। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুলাল খানের ওপর তিন দফা হামলা চালিয়েছে সিদ্দিক বাহিনী। এর মধ্যে একবার তার মোটরসাইকেল আগুনে পুড়িয়ে দিলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দুলাল খান। নিজের ওপর হামলা এবং তার বাড়িঘর ভাঙচুরের ঘটনায় তিনটি মামলা করেন দুলাল খান। তবে কেরানীগঞ্জ মডেল থানাপুলিশ প্রথমে সিদ্দিককে অব্যাহতি দিয়ে মামলাগুলোয় ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিয়ে মামলাগুলো পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে স্থানান্তরের আবেদন জানান বাদী। পরে পিবিআই তদন্ত করে হত্যাচেষ্টাসহ দুটি মামলায় আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। ওই দুটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে সিদ্দিকের মাথায়। এর পরও তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি।
আরও পড়ুন : কারাগারে যেভাবে নারীর সঙ্গ পেতেন হলমার্কের জিএম!
এ বিষয়ে দুলাল খান বলেন, আবু সিদ্দিক নিজেই পুলিশের সঙ্গে ঘোরে। পুলিশের অফিসে যায়। পরে এ রকম অবস্থা দেখে আমি পুলিশ সদর দপ্তরকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেই। পুলিশ সদর দপ্তর ঢাকা জেলা পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বললেও রহস্যজনক কারণে কোনো কাজ হয়নি। মনে হচ্ছে বিচার চেয়েই অপরাধ করে ফেলেছি। এখন আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
সরেজমিন দেখা যায়, ঘাটারচর চৌরাস্তার মোড় সিএনজি স্টেশন থেকে কলাতিয়া পর্যন্ত শতাধিক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। অভিযোগ আছে, এসব অটোরিকশা থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তুলে সিদ্দিকের ক্যাডাররা। নিজের ডেইরি ফার্ম ও আটিবাজার হিজলা মার্কেট এলাকায় মাদক ব্যবসা এবং মাদকের আসরও বসায় তারা। বুড়িগঙ্গার পাড় এবং জলাভূমি ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন সিদ্দিক। সব মিলিয়ে মাসে কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য রয়েছে তার।
পিবিআই সূত্র জানায়, আবু সিদ্দিকের ভয়ে এলাকার কেউ কথা বলতে চায় না। তারপরও পিবিআই কর্মকর্তারা কষ্ট করে সাক্ষী জোগাড়ের মাধ্যমে মামলা তদন্ত করেছেন। এই মুহূর্তে পিবিআইর হাতে আবু সিদ্দিকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, যুদ্ধাপরাধীর তালিকায় নাম থাকা আব্দুল খালেকের ভাতিজা আবু সিদ্দিক। প্রথমে জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে নামেন তিনি। ভোল পাল্টে একপর্যায়ে যোগ দেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন। চাঁদাবাজি, জমি দখল, মাদক কারবারসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ায় দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। দলের পদ চলে যাওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সিদ্দিক। সম্প্রতি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্যপদ বাগিয়ে নিয়েছেন। চলাফেরা করেন সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। নিয়মিত যাতায়াত কেরাণীগঞ্জ মডেল থানা ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। এলাকায় নিজেকে ঢাকা জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তার আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। সর্বশেষ গত ১২ জানুয়ারি তিনি পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে যান।
প্রতারণার কাজে ব্যবহারের জন্য কেরাণীগঞ্জের ৩নং তারানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের প্যাড জালিয়াতি করে জনতার হাতে ধরা পড়েন সিদ্দিক। এ ঘটনায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা জিডি করেন চেয়ারম্যান। তবে এবারও সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, এভাবে ইউনিয়ন পরিষদের আমার প্যাড জালিয়াতি করে গণস্বাক্ষর নেওয়ার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশকে জানিয়েছি।
২০১৯ সালের এপ্রিলে চাঁদা না দেওয়ায় শামীম মিয়া নামে এক কলেজছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে সিদ্দিক বাহিনী। শামীম তিতুমীর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফেরেন শামীম। আহত শামীমের বড় ভাই মামুন হোসেন বলেন, কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নের ছোট ভায়াল গ্রামে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিদ্দিক আমাদের কাছে চাঁদা চেয়ে আসছিলেন। দিতে অস্বীকৃতি জানালে সিদ্দিকসহ ১০/১৫ জনের একটি দল আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমার ছোট ভাই শামীমকে বেধড়ক পেটায়।
দুই মেয়েবন্ধুসহ চার তরুণ গত ২০ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তারানগর ইউনিয়নে ঘুরতে যান। হঠাৎ একদল বখাটে তাদের জিম্মি করে টাকা দাবি করে। ওই বখাটেরা আবু সিদ্দিকের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচিত। খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। তবে বখাটেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আবু সিদ্দিক বলেন, আমার প্রতিপক্ষ অনেক অপপ্রচার করে থাকে। আমার শ্যালক আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে সেটা আমি মিটিয়ে দিয়েছি। নিজের দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি কেরাণীগঞ্জ মডেল থানার সাবেক ওসি শাকের মোহাম্মাদ জুবায়েরকে ‘আমাদের ছেলে’ বলে বার বার সম্বোধন করছিলেন। জানতে চাইলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, সিদ্দিকের নামে এতগুলো মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
সূত্র: আমাদের সময়
এন এ/ ২৩ জানুয়ারি