জামালপুর

মৃত ব্যক্তি শুধু মাটিই কাটেন না, ব্যাংক থেকে টাকাও তোলেন

আতিকুল ইসলাম রুকন

জামালপুর, ২২ জানুয়ারি – মন্দা মৌসুমে অতিদরিদ্র মানুষের স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম ফর দ্য পুওরেস্ট বা ইজিপিপি নামের একটি কর্মসূচি রয়েছে। জামালপুরে এ কর্মসূচির আওতায় মাটি কেটেছেন মৃত এক ব্যক্তি। এ কাজের বিপরীতে তিনি ব্যাংকের চেক পেয়েছেন এবং সেই চেক দিয়ে যথারীতি ব্যাংক থেকে টাকাও উত্তোলন করেছেন।

এখানেই শেষ নয়। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ইজিপিপির চলমান প্রকল্পেও শ্রমিকের তালিকায় তার নাম রয়েছে। উপরন্তু এই মৃত ব্যক্তির পরিবার হতদরিদ্র নয়, খুবই সচ্ছল। তার বাবা স্থানীয় ইউপি মেম্বার। বিস্ময়কর এ ঘটনার স্থান মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়ন।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঘোষেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার কাহেতপাড়া গ্রামের মো. চান মিয়ার চার ছেলে। এর মধ্যে বড় ছেলে সিঙ্গাপুর প্রবাসী, মেজো ছেলে আসলাম বেকার, সেজো ছেলে আছাদুজ্জামান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৯ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন এবং ছোট ছেলে আপেল অনার্স শিক্ষার্থী। অতিদরিদ্রদের জন্য সাময়িক কর্মসংস্থান কর্মসূচি ইজিপিপি প্রকল্পের ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে শ্রমিকের তালিকায় ইউপি সদস্য চান মিয়ার মেজো ছেলে আসলাম ও সেজো ছেলে মৃত আছাদুজ্জামানের নাম রয়েছে। এ দুজনের নামে বছর শেষে টাকাও উত্তোলন করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ইজিপিপি বাস্তবায়ন কমিটির জেলাপর্যায়ের সদস্য এবং জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, এ প্রকল্পে শুরু থেকেই যে দুর্নীতি হয়, এর জ¦লন্ত প্রমাণ হচ্ছে সচ্ছল চান মিয়া মেম্বারের ঘটানো এ কা-। প্রকল্পটি বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে হয় শুধু হতদরিদ্রদের উপকারের লক্ষ্যে। কিন্তু বাস্তবে দরিদ্ররা এখান থেকে কোনো উপকার পাচ্ছে না। কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধি এ প্রকল্প থেকে সরকারের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ইজিপিপি প্রকল্পে কেউ মাটি না কাটলে তাকে টাকা দেওয়া হয় না। আর শ্রমিককে সশরীরে উপস্থিত হয়ে টিপসই বা স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক থেকে চেক উত্তোলন করতে হয়। তা হলে ধরা যায়, চান মিয়ার ছেলে মারা যাওয়ার পরও প্রকল্পের মাটি কেটেছেন এবং ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন। এর পরই তিনি এ বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের যথোপযুক্ত শাস্তির দাবি জানান।

আরও পড়ুন : বিয়ের নামে সুন্দরীরা যেভাবে প্রতারণা করছে

স্থানীয় এক ইউপি সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, শুধু মৃত ব্যক্তির নামেই নয়, ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে ভুয়া অনেকের নাম শ্রমিকের তালিকায় দেখিয়ে লাখ লাখ হাতিয়ে নেন ইউপি চেয়ারম্যানসহ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। এভাবে প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকা ভাগভাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। জানা গেছে, চান মিয়ার এ কা-ে ক্ষোভ বিরাজ করছে স্থানীয়দের মাঝে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চান মিয়ার সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার ছেলে আছাদুজ্জামান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে দেড় বছর আগে। ইজিপিপি প্রকল্পের ২০২০-২১ অর্থবছরের শ্রমিকদের তালিকায় আছাদের নাম আমি দিইনি। আছাদের ভোটার কার্ড দিয়ে আমার ছোট ছেলে আপেল নাম দিছে। আমি বিষয়টি জানতাম না। ছোট ছেলেটা অনার্সে পড়ে। ভাবছে, ভাইয়ের ভোটার কার্ড দিয়ে আমি মাটি কাটমু। আসলে কাজটা আমাদের ভুল হইছে।

২০১৯-২০ অর্থবছরেও শ্রমিক তালিকায় আছাদুজ্জামানের নাম থাকা এবং ব্যাংক থেকে তার টাকা উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে চান মিয়া বলেন, আমার ছেলে মরার পর ওর নামে ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তুলি নাই আমি। কেউ হয়তোবা তুলে থাকতে পারে। বিষয়টি আমার জানা নেই।

সচ্ছল হওয়ার পরও তার দুই ছেলের নাম কেন শ্রমিকদের তালিকায়? এমন প্রশ্নে চান মিয়া বলেন, আমার সেজো ছেলে আছাদুজ্জামান তো মারাই গেছে। মেজো ছেলে আসলামের নাম দিয়েছি। কারণ সে এখন বেকার। বেকু দিয়ে প্রকল্পের মাটি কাটলে আসলাম আমার কাজে সাহায্য করে। তাই আসলামের নাম দিছি।’ তিনি যোগ করেন, আমার তো টাকা-পয়সা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার ছেলেদের তো নিজের কিছু নাই। তাই ওদের নাম দিছি।’

ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের হাজরাবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক মো. মামুনুর রশিদের সঙ্গে কয়েক দফা চেষ্টার পর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইজিপিপি প্রকল্পের প্রথম কিস্তির সাত হাজার টাকা ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে চেকের মাধ্যমে শ্রমিকদের মাঝে প্রদান করা হয়। ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মো. আছাদুজ্জামানের নামে বরাদ্দকৃত সাত হাজার টাকার চেকটিও প্রদান করা হয়েছে।

আরও পড়ুন : স্বামীর প্ররোচনায় ভয়ংকর হয়ে ওঠেন গৃহকর্মী রেখা

মৃত ব্যক্তি কীভাবে চেক দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করে? এমন প্রশ্নে ব্যাংক ম্যানেজার বলেন, আমি ছয় মাস আগে এ শাখায় যোগ দিয়েছি। মৃত ব্যক্তির নামে কীভাবে চেক ইস্যু করা হয় বা মৃত ব্যক্তি কীভাবে চেক গ্রহণ করে, তা আমার জানা নেই। আমার আগের কর্মকর্তা বলতে পারবেন। মৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর বা টিপসই জাল করা হয়েছে কিনা, এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

মেলান্দহ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তামিম আল ইয়ামিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, মৃত ব্যক্তির ব্যাংক থেকে টাকা তোলার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। তিনি আরও বলেন, শ্রমিক তালিকায় মৃত ব্যক্তির নাম থাকার সুযোগ নেই। যদি থেকে থাকে, তদন্ত করে সেই নাম আমরা বাদ দেব।

জামালপুর জেলার জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ইজিপিপিতে মৃত ব্যক্তির নাম থাকা ও টাকা তোলার বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগও আমি পাইনি। আপনি যেহেতু বলেছেন, সেহেতু এখন আমরা তদন্ত করব এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। দোষী হলে কেউই ছাড় পাবে না। তার বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী সব ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

২০১৯-২০ অর্থবছরের ইজিপিপির কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে এবং ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষদিকে শ্রমিকদের বিল প্রদান করা হয়।

সূত্র : আমাদের সময়
এন এ/ ২২ জানুয়ারি

Back to top button