জাতীয়

হালকা যানের লাইসেন্সে বাস চালাচ্ছিলেন চালক

সিরাজুল ইসলাম

ঢাকা, ২০ জানুয়ারি- রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের পদ্মা অয়েল গেটের কাছে স্বামী-স্ত্রীকে চাপা দেওয়া বাসচালকের ভারী যানের লাইসেন্স নেই। হালকা যানের লাইসেন্স দিয়েই তিনি ভারী যান চালাচ্ছিলেন।

গ্রেফতারের পর ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) ও থানা পুলিশকে নিজেই এ তথ্য জানিয়েছেন চালক তসিকুল ইসলাম (২৮)। সোমবার রাতে তাকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনে আজ তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হবে। এদিকে নিহত আকাশ ইকবাল (২৬) ও হাজারিকা মায়া মিতু (২২) দম্পতির চার বছর বয়সি একমাত্র কন্যাসন্তান আফরা আনজুম এখনো জানে না, তার মা-বাবা বেঁচে নেই। সে শুধুই কান্না করছে।

মাঝেমধ্যে ফ্যালফেলিয়ে তাকাচ্ছে আর এদিক-সেদিক মা-বাবাকে খুঁজছে। শিশুটি এখন গ্রামের বাড়িতে দাদা-দাদির হেফাজতে আছে। অন্যদিকে পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎসকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে আকাশের মা-বাবা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নিহত দম্পতির পারিবারিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আকাশের ছোট ভাই কামরুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বাবা জাফর ইকবাল এক সময় কৃষিকাজ করতেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় এখন বাড়িতেই থাকেন। তেমন কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। মা গৃহিণী। একমাত্র বড় বোনকে অনেক আগে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ফরিদপুর পলিটেকনিক্যালে পড়ি।

আমাদের পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল ভাই আকাশ। ঢাকায় নিজ পরিবারের ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি ভাই প্রতি মাসে বাড়িতে পাঁচ থেকে সাত হাজার করে টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে আমাদের সংসার ও আমার পড়ালেখা চলত। ভাই যেদিন মারা যান তার আগের রাতেও বই কেনার জন্য আমার বিকাশে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাঠিয়ে ফোন করেছেন।

আরও পড়ুন :  ‘ঘাতক’ বাসচালক দায় চাপালেন নিহত আকাশের ওপর

বলেছেন, ওই টাকা দিয়ে বই কিনে নিস। বেতন পাওয়ার পর বাড়িতে আবার টাকা পাঠাব। ঘটনার দিন সকালেও আমাকে ফোন করে বলেছেন, আমি অফিসে যাচ্ছি। অফিসে গিয়ে তোর সঙ্গে অনলাইনে গেমস খেলব। এর ঠিক আধা ঘণ্টা পরই পুলিশ ফোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম ভাই আর ভাবি নেই।’

আকাশের ফুপাতো ভাই মিজানুর রহমান জানান, আকাশের অফিস শুরু হয় সকাল ১০টায়। কিন্তু তার স্ত্রীর অফিস শুরু হয় সকাল ৮টায়। তাই প্রতিদিন স্ত্রীকে অফিসে নামিয়ে দিতে মোটরসাইকেল নিয়ে আগেই বাসা থেকে বের হন।

স্ত্রীকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই নিজ অফিসে পৌঁছান। কিন্তু তার অফিস শুরু হয় ১০টার দিকে। তাই এক-দেড় ঘণ্টা সময় তিনি প্রায়ই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে গেমস খেলে সময় কাটাতেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বাদ জোহর ফরিদপুর সদরের দুদলী গ্রামে জানাজা শেষে আকাশ-মায়ার লাশ দাফন করা হয়েছে।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুক্তা ধর এ প্রতিবেদককে বলেন, গাড়ি চালিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় চালক তসিকুল ইসলামকে গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শেরপুর গ্রামে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছে তসিকুল। সে জানিয়েছে, তার ভারী গাড়ি চালানোর কোনো লাইসেন্স নেই। হালকা জানের লাইসেন্স দিয়েই দীর্ঘদিন সে গাড়ি চালাচ্ছিল।

যথাযথ লাইসেন্স না থাকার পরও তসিকুলের হাতে গাড়ি তুলে দিয়ে গাড়ির মালিক কামরুল হাসানও অন্যায় কাজ করেছেন। তিনি বলেন, মামলাটি যেহেতু বিমানবন্দর থানা পুলিশ তদন্ত করছে, তাই গ্রেফতার আসামিকে আজ (মঙ্গলবার) থানায় বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে থানা পুলিশই পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ইমরান হোসেন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তসিকুল জানিয়েছে, ভোরের দিকে রাস্তায় কুয়াশা বেশি ছিল। এ জন্য সামনে বেশিদূর দেখা যাচ্ছিল না। মোটরসাইকেলটি একবার ডানদিকে এবং অন্যবার বাম দিকে যাচ্ছিল।

এ কারণে সে কোনদিক দিয়ে ওভারটেক করবে তা বুঝতে পারছিল না। এক পর্যায়ে মোটরসাইকেলটি রাস্তায় হঠাৎ থেমে পড়ে। সম্ভবত মোটরসাইকেলের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। তসিকুল পুলিশকে আরও জানায়, তার গাড়িটি স্পিডে থাকার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে থামাতে পারেনি। এ কারণে মোটরসাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পরে গাড়িটি তাদের ওপর উঠে পড়ে। আত্মরক্ষার্থে সে (তসিকুল), হেলপার ও ভাড়া আদায়কারী পালিয়ে যায়।

তদন্ত কর্মকর্তা আরও জানান, আসামিকে আগামীকাল (আজ) আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানানো হবে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য বের করা সম্ভব হবে। গাড়ির হেলপার ও ভাড়া আদায়কারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স না থাকার পরও কেন গাড়িটি তসিকুলের হাতে তুলে দেওয়া হলো-এই প্রশ্নের জবাবে গাড়ির মালিক কামরুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই এটি এখন আদালতের বিচার্য বিষয়। আদালত যে রায় দেবে সেটাই মেনে নেব। এর বাইরে এ নিয়ে এখন কিছু বলতে চাচ্ছি না।

উল্লেখ্য, সোমবার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে পদ্মা অয়েল গেটের কাছে গাড়িচাপায় স্বামী আকাশ ও স্ত্রী মায়া হাজারিকা নিহত হন। আনুমানিক সকাল সোয়া ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আকাশ ইকবাল পদ্মা সেতু প্রকল্পে এবং মায়া হাজারিকা হোটেল লেক ক্যাসলে চাকরি করতেন। দুজন কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার উদ্দেশে মোটরসাইকেলে রওয়ানা হয়েছিলেন।

বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন টার্মিনালের কাছের ইউলুপ সংলগ্ন এলাকায় আজমেরী বাসের ধাক্কায় নিহত হন তারা। এ ঘটনায় সোমবার বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। মামলার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই প্রযুক্তির সহায়তায় মূল আসামিকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

আদাবরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পুলিশ সদস্যের মৃত্যু : রাজধানীর আদাবরে সড়ক ও জনপথ ভবনের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পুলিশ সদস্য শহিদুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চার নম্বর কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার কিসমত ভূঁইয়াপাড়ায়। সোমবার সকালে দুর্ঘটনার শিকার হন শহিদুল।

সূত্র: যুগান্তর

আর/০৮:১৪/২০ জানুয়ারি

Back to top button