ইসলাম

পরকালে আফসোস করবে যারা

মুফতি আমিরুল ইসলাম লুকমান

ইমান পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। ইমানহীন জীবন অন্ধকারাচ্ছন্ন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইমানের মাধ্যমেই আমাদের মর্যাদাবান করেছেন। দুনিয়া হলো আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। পরকালের সঞ্চয় ও পাথেয়রূপে যা কিছু প্রয়োজন এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। জীবনপ্রদীপ নিভে যাওয়ার পর অর্জনের কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকবে না। দুনিয়ার জীবন পুরোটাই যিনি আখেরাতের পাথেয় অর্জনে ব্যয় করেন তিনিই বুদ্ধিমান। ভীষণ গুনাহগারও ইমান নিয়ে মারা গেলে একদিন জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হবেনই। তবে ইমানহারা হয়ে মারা গেলে পরকালে আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি, যেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং অবিশ্বাসী ব্যক্তি বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম!’ (সুরা : নাবা, আয়াত : ৪০)

আয়াতের তাফসিরে ইবনে ওমর (রা.) বলেন, কিয়ামতের দিন সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ এক সমতলভূমিতে পরিণত হবে। তাতে মানুষ, জিন, জীবজন্তু সবাইকে একত্রিত করা হবে। জন্তুদের মধ্যে কেউ দুনিয়াতে অন্য জন্তুর ওপর জুলুম করে থাকলে তার কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এমনকি কোনো শিংবিশিষ্ট ছাগল কোনো শিংবিহীন ছাগলকে মেরে থাকলে সেদিন তারও প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এই কর্ম সমাপ্ত হলে সব জন্তুকে আদেশ করা হবে, মাটি হয়ে যাও। তখন সব মাটি হয়ে যাবে। এই দৃশ্য দেখেই অবিশ্বাসীরা আক্ষেপ করবে বলবে, হায়! আমরাও যদি মাটি হয়ে যেতাম! এমন হলে আমরা হিসাব-নিকাশ ও জাহান্নামের আজাব থেকে বেঁচে যেতাম। (সংক্ষিপ্ত মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ১৪৩৩)

অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন জাহান্নামকে সামনে আনা হবে এবং মানুষ উপলব্ধি করতে পারবে, কিন্তু এই উপলব্ধি তার কী কাজে আসবে? সে বলবে, হায়! আমি যদি আমার এ জীবনের জন্য কিছু (সৎকর্ম) অগ্রিম পাঠাতাম! সেদিন আল্লাহর সমান শাস্তিদাতা কেউ হবে না।’ (সুরা : ফজর, আয়াত : ২৩-২৫)

সেদিন অবিশ্বাসী বুঝতে পারবে, দুনিয়াতে তার কী করা উচিত ছিল আর সে কী করেছে। কিন্তু তখন এই বুঝে আসা নিষ্ফল হয়ে যাবে। কেননা, পরকাল কর্মজগৎ নয়, প্রতিদান জগৎ। এরপর সে অভিলাষ ব্যক্ত করবে, হায়! আমি যদি দুনিয়াতে কিছু সৎকর্ম করতাম! কিন্তু কুফর ও শিরকের শাস্তি সামনে এসে যাওয়ার পর এ আকাক্সক্ষায় কোনো লাভ নেই। এখন জবাবদিহি, আজাব ও পাকড়াওয়ের সময়। আল্লাহতায়ালার পাকড়াওয়ের মতো কঠিন পাকড়াও কারও হতে পারে না। (সংক্ষিপ্ত মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা : ১৪৫৬)

আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘সীমালঙ্ঘনকারী সেদিন (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে আর বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি রাসুলের সঙ্গে একই পথ অবলম্বন করতাম! হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে তো উপদেশ এসেছিল, কিন্তু সে আমাকে তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ২৭-২৯)

আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার বিশেষ প্রেক্ষাপট হলো, উতবা ইবনে আবি মুয়িত নবী করিম (সা.)-কে পরিত্যাগ করে বিখ্যাত কাফির নেতা উবাই ইবনে খালফকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং নবী করিম (সা.)-কে অপমান করেছিলেন। উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতগুলো নাজিল হয়। তবে আয়াতের ভাষা ও বিধান ব্যাপক। যে দুই বন্ধু পাপকাজের জন্য মিলিত হয় এবং শরিয়তবিরোধী কাজে একে অপরের সাহায্য করে, তাদের বিধান হলো, কিয়ামতের দিন তারা এই বন্ধুত্বের কারণে শাস্তিভোগ করবে এবং কান্নাকাটি করবে। হাদিস শরিফে কোনো অবিশ্বাসীকে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতে নিষেধ করা হয়েছে। যাকে দেখে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যার কথাবার্তায় জ্ঞান বাড়ে এবং যার কাজ দেখে পরকালের স্মৃতি তাজা হয়, তাকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে আদেশ করেছেন রাসুল (সা.)। (সংক্ষিপ্ত মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৯৫৯)

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যেদিন আগুনে তাদের মুখ উল্টেপাল্টে দগ্ধ করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায় আফসোস! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রাসুলের আনুগত্য করতাম।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬৬)

আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আর আপনি যদি দেখতেন, যখন তাদের জাহান্নামের পাশে দাঁড় করানো হবে। তারা বলবে, কতই না ভালো হতো, যদি আমাদের আবার পৃথিবীতে পাঠানো হতো! তাহলে আমরা স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শনাবলিতে মিথ্যারোপ করতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ২৭)

আয়াতে অবিশ্বাসী, অপরাধীদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, পরকালে যখন তাদের জাহান্নামের কিনারায় দাঁড় করানো হবে এবং তারা কল্পনাতীত ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা আফসোস করে বলবে, ফের দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলে আমরা পালনকর্তার প্রেরিত আদেশ ও নির্দেশনাবলিকে মিথ্যারোপ করতাম না, বরং এগুলো বিশ্বাস করে ইমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। পরের আয়াতে তাদের আফসোসের রহস্য উন্মোচন করে বলা হয়েছে, এরা চিরকালই মিথ্যায় অভ্যস্ত। আসল ব্যাপার হলো, পয়গম্বরের মাধ্যমে যেসব বাস্তব সত্য তাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল এবং তারা তা জানা ও চেনার সত্ত্বেও শুধু হঠকারিতা বা লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে এসব সত্যকে পর্দায় আবৃত রাখার চেষ্টা করত। (সংক্ষিপ্ত মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা ৩৭৪)

উপর্যুক্ত আয়াত ও তাফসির থেকে বুঝতে পারি, ইমানহীন জিন্দেগির পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। তাই আমাদের জীবনে ইমানের শক্তি ও মাত্রা কীভাবে পূর্ণতা পায়, সে বিষয়ে যতœবান হতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী সোনালি প্রজন্ম যেভাবে ইমান হেফাজত ও রক্ষার জন্য সদা সচেষ্ট থেকেছেন, আমাদেরও তেমন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ইমান নষ্ট হয়ে যায় এমন কোনো কথা-কাজ কখনোই আমাদের থেকে যেন প্রকাশ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ত্রুটি ও দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ কোনোক্রমেই দেওয়া যাবে না।

আডি/ ০১ জানুয়ারি

Back to top button