জানা-অজানা

ইহুদীরাও ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে

শুরুতেই ইহুদিদের ধর্ম সম্পর্কে আপনাকে একটু জেনে নিতে হবে। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মতোই ইহুদিগণ পূর্বের সকল বাণীবাহককে বিশ্বাস করেন, এবং মনেকরেন, মোশি হলেন ঈশ্বরের একজন বাণী বাহক। ইহুদিগণ যিশুকে ঈশ্বরের বাণী বাহক হিসেবে অস্বীকার করলেও, খ্রিস্টানগণ ইহুদিদের সবগুলো পুরাতন নিয়ম ধর্মগ্রন্থকে নিজেদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্য করে থাকেন। আবার ইহুদিধর্মকে সেমেটিক ধর্ম হিসেবেও অভিহিত করা হয়। `ইহুদি` শব্দটি এসেছে শব্দ `ইয়াহুদা` থেকে যিনি ছিলেন নবী মোশির পূর্বপুরুষ ও ইয়াকুব এর পুত্র ও নবী ইউসুফ এর বড় ভাই ৷ তবে ইহুদি শব্দের শাব্দিক অর্থ হয় ‘প্রশংসাকারী’। ইহুদি ধর্মের বয়স প্রায় ৪০০০ বছর ।

এই ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পুরাতন নিয়ম-এর প্রথম পাঁচটি বইকে গণ্য করা হয়: আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক, লেবীয় পুস্তক, গণনাপুস্তক, এবং দ্বিতীয় বিবরণ। এই পাঁচটি বইকে একত্রে “তোরাহ”ও বলা হয়ে থাকে। `তোরাহ` শব্দটির অর্থ ` আইন `। ইহুদীদের ধর্মযাজককে বলা হয় ‘রাব্বি` বা গুরু।

বাংলাদেশের ইহুদীদের ইতিহাস বলতে পুর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র ইহুদি সম্প্রদায়ের ইতিহাস বোঝায়। দেশটিতে ইহুদিদের ইতিহাস ১৮ ও ১৯ শতকে পাওয়া যায়। ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের ইহুদিদের একটি ছোট সম্প্রদায় ছিল যা বর্তমান বাংলাদেশের বিশেষত ঢাকা শহরে ছিল। রাজশাহীতে ইহুদি বাসিন্দাদেরও খবর পাওয়া গেছে। ইতিহাসমতে বাংলাদেশের ইহুদিরা বাগদাদি এবং বেন ইস্রায়েল ইহুদী। এই ইহুদিদের বেশিরভাগই ১৯৬০ এর দশকে দেশত্যাগ করেছিলেন।

আরও পড়ুন ::

পৃথিবীতে ইহুদীদের মোট সংখ্যা দেড় কোটির মত। একটি মাত্র ইহুদী রাষ্ট্র – ইসরাইল। ইসরাইলে ইহুদীর সংখ্যা ৫৪ লাখ, অবশিষ্ট প্রায় এক কোটি ইহুদী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে আমেরিকাতে ৭০ লাখ, কানাডাতে ৪ লাখ আর ব্রিটেনে ৩ লাখ ইহুদী থাকে। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদী! কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকা শহরের কাছাকাছি হলেও বিশ্বে ইহুদি সম্প্রদায় থেকে যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি।

মেসোপটেমিয়ান ইহুদীরা, যারা বাগদাদী ইহুদি নামেও পরিচিত, পূর্ব বাংলার শহরে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মুঘল আমলে পূর্ববাংলা বাংলায় সমৃদ্ধশালী মসলিন ব্যবসার কারণে ইউরেশীয় বণিকদের কেন্দ্রস্থল ছিল। বাগদাদী ইহুদি বণিকরা ঢাকাতে ১৮ শতকের বসতি স্থাপন করতে পারেন। অঞ্চলটি পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। উপনিবেশিক আমলের একটি উল্লেখযোগ্য পর্বে জার্মান ইহুদি শিক্ষাবিদ এবং নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বন্ধু অ্যালেক্স অ্যারনসনের জড়িত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের সময়, অ্যারনসনকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক সরকার শত্রু হিসাবে দেখত।

ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও তিনি এক্সিস জার্মানির গুপ্তচর ছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। আরনসনকে আটক করা হয়েছিল এবং তাকে গৃহবন্দী হয়েছিল, যা শান্তিনিকেতন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাজ ব্যাহত করে। তাঁর বন্ধু ঠাকুর তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন তবে প্রাথমিকভাবে ঠাকুরের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এরপরে ঠাকুর আরনসনকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সহায়তা নিয়েছিলেন।

১৯৪১ সালে ঠাকুরের মৃত্যুর পরে, আরনসন, ঢাকা নবাব পরিবারের সদস্য স্যার নাজিমউদ্দিনের নিজ শহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।ইহুদিরা মূলত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা কেন্দ্রিক ছিলেন। তারা একটি সম্পূর্ণ সম্প্রদায় তৈরি করতে, ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য সিনাগগ, স্কুল এবং হাসপাতাল তৈরি করতে পেরেছিলেন, যেখানে পূর্ববাংলার ইহুদিরা মূলত কলকাতা থেকে আগত প্রবাসীরা বাণিজ্যিক কারণে সেখানে বাস করতেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভাগের সময় পূর্ববঙ্গে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩৫। রাজশাহীতে জন্মগ্রহণকারী মরদেচাই কোহেন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় পাকিস্তান টেলিভিশনের জন্য ইংরেজি ও বাংলা নিউজ রিডার হয়েছিলেন। বেন ইস্রায়েল সম্প্রদায়ের সদস্যরাও ১৯৬০ এর দশকে ঢাকায় বসবাস করেছিলেন। ১৯৬০ এর দশকের শেষদিকে, ইহুদি সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ অংশ কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর মতে, “বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরে দুটি ইহুদি পরিবার ছিল, তবে উভয়ই ভারতে পাড়ি জমায় – একটি ১৯৭৩ সালে এবং অন্যটি ১৯৭৫ সালে।”

পোলিশ-আমেরিকান ইহুদি স্থপতি লুই কান পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন-পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ভবনের নকশা তৈরির জন্য কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব পাকিস্তানের আত্মসমর্পণে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইহুদি টেলিগ্রাফ সংস্থার একটি রেকর্ড অনুসারে ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে বলা হয় যে “ইস্রায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।” বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শুক্রবার এক বেতার বার্তায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবা ইবান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদকে এই স্বীকৃতি জানান। সেদিনের নিয়মিত মন্ত্রিসভার সভার অপেক্ষা না করে শুক্রবার মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্যের সাথে টেলিফোনের পরামর্শের পরে এই স্বীকৃতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পুর্বে এপ্রিলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম এবং বাঙালি অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাক আহমেদের চিঠিতে ইসরায়েলি স্বীকৃতিটির জন্য প্রথমে অনুরোধ করা হয়েছিল যারা তৎকালীন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতা যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ও ইস্রায়েলের মধ্যে সরকারিভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।

সূত্র: বাংলা ইনসাইডার

আর/০৮:১৪/৩০ ডিসেম্বর

Back to top button