জাতীয়

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে খরচ হবে ৬৪ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর- অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি)। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ (দেশীয়) উৎস থেকে ৫৭ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ব্যয় হবে ৭৪ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। এছাড়া মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ লাখ ৩০ হাজার ১২০ কোটি এবং ব্যক্তি খাত থেকে ৫২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। এছাড়া পরিকল্পনা মেয়াদে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ৩২ লাখ ৫০ হাজার এবং দেশীয় ৮০ লাখ ৫০ হাজার কর্মসংস্থান হবে।

মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গণভবন থেকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী ও এনইসি চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা। সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম পরিকল্পনার সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।

বৈঠক শেষে এনইসি সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ সময় বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন জিইডির সদস্য ড. শামসুল আলম। উপস্থিত ছিলেন- পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম, আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য জাকির হোসেন আকন্দ, আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।

পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, পরিকল্পনার বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন দেশে আরও অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হবে। এক্ষেত্রে শুধু যে বিদেশে রফতানিমুখী শিল্পের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হবে তা নয়, দেশীয় বাজারে পণ্যের জন্যও করা হবে। ফলে দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশ থেকে মেধা বিদেশে চলে যাবে না। এছাড়া ফসলি জমি রক্ষায় ইউনিয়নভিত্তিক ল্যান্ড ইউস প্ল্যান তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা বা বাড়িঘর তৈরিতে যাতে ধান, পাট বা যে কোনো ফসলি জমি নষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এটা একটা জেনারেল নির্দেশনা। তবে ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো এটি বাস্তবায়ন করবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প ও নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে এ পরিকল্পনার নীতি ধারাবাহিকতার দিকটিতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) লক্ষ্যগুলো এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এসব লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টাকে অব্যাহতভাবে অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

ব্রিফিংয়ে ড. শামসুল আলম জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে বার্ষিক গড় জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অর্জন হবে ৮ শতাংশ হারে। এবং পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। এতে দেশের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ৫ দশমিক ২ শতাংশ, ৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হবে। পরিকল্পনায় বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তিনি আরও জানান, ২০২৫ সাল নাগাদ কর জিডিপির অনুপাত বর্তমানের ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হবে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমাতে এ দুই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজস্ব আইন অধিকতর সংস্কার এবং কর প্রশাসনে আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে।

এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা শেষ অর্থবছরে দেশের দারিদ্র্য হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দারিদ্র্যের হার ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের লক্ষ্য হচ্ছে যথাক্রমে ২৩ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, ১৭ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া চরম দারিদ্র্য যথাক্রমে ১২ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ৯ দশমিক ১ শতাংশ, ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য রয়েছে।

কোভিডের প্রভাব : কোভিড-১৯ এর ধাক্কা লেগেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পাঁচ খাতে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোভিড পূর্ব প্রত্যাশিত ফলাফল ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর কোভিড পরবর্তী ফল দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। এক্ষেত্রে চলতি মূল্যে কোভিডের আগে প্রত্যাশিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৮ হাজার ৮৫৯ বিলিয়ন টাকা, সেখান কোভিড পরবর্তী ফল ২৭ হাজার ৯৬৪ বিলিয়ন টাকা।

এছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ প্রত্যাশা করা হলেও অর্জন হয়েছে ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। রফতানি কোভিডের আগে ৪৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার প্রত্যাশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে জিডিপির ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ প্রত্যাশা করা হলেও কোভিড পরবর্তী হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ এছাড়া মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ আশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত হয়েছে ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

করোনা মোকাবেলা ও আর্থিক পুনরুদ্ধারে ২৪৪ উন্নয়ন কৌশল : কোভিড-১৯ মোকাবেলাসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৪৪টি উন্নয়ন কৌশল নেয়া হয়েছে অনুমোদিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। শুধু করোনা মোকাবেলায় আসছে পাঁচটি কৌশল। এছাড়া আন্তঃসম্পর্কিত উন্নয়ন কৌশল রয়েছে ছয়টি। পশ্চাৎপদ অঞ্চলের দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবেলায় ছয়টি কৌশল। সেই সঙ্গে খাতভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল রয়েছে ২২৭টি কৌশল। ১৪টি অধ্যায়ে এসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় কৌশলগুলো হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প ও নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে পরিকল্পনায় নীতি ধারাবাহিকতার দিকটিতে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হবে। এক্ষেত্রে যেসব কার্যসম্পাদক সূচকে বাংলাদেশ এখনও পিছিয়ে আণে সেসব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

এছাড়া অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া খাতগুলো সংস্কারের গতি বাড়ানোর বিষয়টি কোভিডের কারণে আরও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট সাময়িক বেকারত্বসহ বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে কোভিড-১৯ মহামারীসহ ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ক্রমান্বয়ে একটি সর্বজনিন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বা ইউনিভার্সেল হেলথ সিস্টেম প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা এবং প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াতে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা হবে।

সূত্র: যুগান্তর

আর/০৮:১৪/২৯ ডিসেম্বর

Back to top button