পশ্চিমবঙ্গ

খেলা ঘোরাচ্ছে বাংলাই, লগ্নি করুন, বার্সেলোনার শিল্প সম্মেলনে আবেদন জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা

কলকাতা, ২০ সেপ্টেম্বর – মাদ্রিদের পর বার্সেলোনা— স্পেনের বণিকমহলের সামনে শিল্পস্থাপন এবং লগ্নির জন্য বাংলার উর্বর মাটির কথা আবার তুলে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রত্যয়ের সঙ্গেই জানালেন, ভারতকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলা। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলা এখন দেশের মধ্যে সবচেয়ে উন্নতিশীল রাজ্য। আমরাই দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। আমরাই গেম চেঞ্জার। তাই আমাদের রাজ্যে বিনিয়োগ করুন। কোনও সমস্যা হবে না। জমি থেকে যোগাযোগ, প্রশিক্ষিত শ্রমিক থেকে সরকারি সুবিধা— সবটা পাবেন।’’

মঙ্গলবার মমতার স্পেন সফরের সপ্তম দিন। মাদ্রিদে চার দিন ছিলেন। গত রবিবার বার্সেলোনা পৌঁছন। এল প্যালেস হোটেলের গ্র্যান্ড ভিয়া হলে বসেছিল মঙ্গলবারের শিল্প সম্মেলন। মাদ্রিদের মতো এখানেও কর্মসূচি সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। বক্তাদের তালিকায় ছিলেন স্পেনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েক। তিনিও তাঁর বক্তৃতায় বাংলায় বিনিয়োগের সুবিধার দিক তুলে ধরেন। ভারতীয় শিল্পমহলের তরফে অম্বুজা রিয়্যালটির চেয়ারম্যান হর্ষ নেওটিয়া, টিটাগড় ওয়াগন লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান উমেশ চৌধুরী, প্রবাসী শিল্পপতি কমল মিত্তল, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ়ের প্রেসিডেন্ট তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা এবং ফেনেসিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান রমেশ জুনেজা বাংলায় বিনিয়োগের সুপরিবেশের কথা তুলে ধরেন।

একটা সময়ে বাংলায় বন্‌ধ আর ধর্মঘট শিল্পমহলের কাছে বিরক্তির বিষয় ছিল। বার্সেলোনার বণিকমহলের সামনে সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আগে বাংলায় ধর্মঘটের সমস্যা ছিল। অনেক কর্মদিবস নষ্ট হত। কিন্তু এখন আমরা সে সব বন্ধ করে দিয়েছি। একটাও কর্মদিবস নষ্ট হয় না।’’ একই কথা উঠে আসে শিল্পপতি হর্ষের বক্তৃতাতেও। অম্বুজা গোষ্ঠীর কর্ণধার বলেন, ‘‘গত ১০ বছরে বাংলায় অভূতপূর্ব পরিকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। শ্রমিক সমস্যা শূন্য, কোনও ধর্মঘট নেই।’’ নেওটিয়া পরিবার ১০০ বছরের বেশি বাংলায় রয়েছে। সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে হর্ষ বলেন, ‘‘বাংলায় কখনও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কখনও তা স্তিমিত হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে বাংলা ধারাবাহিক অগ্রগতির পথে এগিয়েছে।’’ স্পেনীয় শিল্পপতিদের সামনে ‘দিদি’ শব্দের ইংরেজি তর্জমা শুনিয়ে হর্ষ বলেন, ‘‘এক জন দিদি যেমন পরিবারকে আগলে রাখেন, তেমনই এই দিদিও রাজ্যকে আগলে রেখেছেন।’’

শিল্পপতি উমেশে চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমাদের সংস্থা ইউরোপের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করছে। কিন্তু আমাদের শুরু থেকে বড় হওয়া— সবটাই বাংলায়। বিনিয়োগের যথার্থ পরিবেশ রয়েছে বলেই অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে রাজ্য।’’ সোমবার মিত্তল গ্রুপ রাজ্যে ২৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছিল। তাদের কর্তা কমল সোমবার হাজির ছিলেন এল প্যালেস হোটেলের বাণিজ্য সম্মেলনে। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে মমতার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।’’

মুকেশ অম্বানীর রিলায়্যান্স গ্রুপের তরফে তরুণ ঝুনঝুনওয়ালা বলেন, ‘‘বাংলায় বিনিয়োগের আদর্শ পরিবেশ রয়েছে বলেই গত ১০ বছরে সেই রাজ্যে রিলায়্যান্সের মতো সংস্থা পাঁচ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তার বেশির ভাগটাই টেলি যোগাযোগ ক্ষেত্রে।’’ তিনিও মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মমতাদি’ বলে সম্বোধন করেন। এবং বলেন, ‘‘মুকেশ অম্বানী চান বাংলার সঙ্গে আমাদের মজবুত সম্পর্কটা যেন টিকে থাকে।’’ শিল্পপতি রমেশ জুনেজা বলেন, ‘‘চর্ম শিল্পে বিনিয়োগের জন্য বাংলা এখন পৃথিবার অন্যতম সেরা গন্তব্য।’’ এই প্রসঙ্গেই তিনি বানতলা লেদার কমপ্লেক্সের কথা তুলে ধরেন।

বাংলা যে গত ১০ বছরে উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক বদলের পথে এগিয়েছে সে কথা উল্লেখ করেন স্পেনে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত দীনেশ পট্টনায়েকও। তাঁর কথায়, ‘‘মমতার নেতৃত্বে বাংলায় বহুমুখী পরিবর্তন হয়েছে। ১০ বছরে বদলে গিয়েছে বাংলা।’’ একই সঙ্গে তিনি বাংলার ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধার কথাও উল্লেখ করেন। বলেন, ‘‘বাংলা ১১ কোটি মানুষের রাজ্য। আর বাংলা হল আরও কয়েক কোটি মানুষের বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রবেশপথ।’’

বার্সেলোনার বাণিজ্য সম্মেলনে শুধু বিনিযোগের আবেদনই জানাননি মমতা, তাঁর সরকারের সামাজিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেন। সামাজিক সুরক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ের কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, ‘‘সমাজের দরিদ্রতম অংশের জীবনে আলো জ্বালাই আমাদের লক্ষ্য। সেই কাজই আমরা করে চলেছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘স্পেন যেমন ইউরোপে নবজাগরণ শুরু করেছিল, বাংলা তেমন ভারতে নবজাগরণ শুরু করেছে।’’ স্পেনের সঙ্গে বাংলার যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে, তা-ও মঙ্গলবার উল্লেখ করেন মমতা। দিদি বলেন, ‘‘আপনারা আঁকা পছন্দ করেন, আমরাও তাই। আপনারা সঙ্গীতভক্ত, আমরাও তেমন। আপনারা যেমন ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা রয়েছে, বাংলাও তেমন ফুটবল পাগল।’’ লা লিগার সঙ্গে রাজ্য সরকারের ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা বলে মমতা বলেন, ‘‘আমরা একটা গোটা স্টেডিয়াম ওদের দিয়ে দিচ্ছি।’’

স্পেনের বণিকমহলের প্রতিনিধি হিসাবে বাণিজ্য সম্মেলনে ছিলেন ‘পিমেক’-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধিকর্তা হাসিন্তো সোলের মাতুতেস। পিমেক হল কাতালোনিয়ার ক্ষুদ্র, ছোট এবং মাঝারি শিল্পমালিকদের প্রায় ৫০ বছরের পুরনো সংগঠন। হাসিন্তো মমতার উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন বিনিয়োগের ডাক নিয়ে।’’ মাতুতোস ইঙ্গিত দিয়েছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভোট হয়ে গেলেই তাঁরা ভারতে বিনিয়োগের ব্যাপারে অগ্রসর হবেন। এশিয়ার আরও দুই দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও যে তাঁদের নজরে রয়েছে তা-ও উল্লেখ করেন তিনি।

কাতালোনিয়ার শিল্পপতিদের ১৯৭১ সালে তৈরি বণিকসভা ‘ফোমেন্ট’-এর তরফ থেকে ছিলেন তাদের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধিকর্তা কিলিয়ান গার্সিয়া। গার্সিয়া বলেন, ‘‘আশা করি ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব।’’ বণিক সংগঠন কাসা এশিয়ার বাণিজ্য অধিকর্তা আমাদে‌ও হেনসানা বলেন, ‘‘সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের ক্ষেত্র বদলাচ্ছে। নতুন নতুন জায়গাও উঠে আসছে। আমরা সেই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই পশ্চিমবঙ্গকে দেখছি।’’

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন
আইএ/ ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

Back to top button