ঢাকা, ০৩ আগস্ট – আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে। এর তিন দিন পরই প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে মোট সাত কিস্তিতে দেবে ঋণের পুরো অর্থ। সেই হিসাবে বাকি আছে আরও ছয় কিস্তি।
অর্থ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ সাধারণত প্রতি কিস্তি দেওয়ার আগে শর্ত পালনের নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করে থাকে। সে অনুযায়ী, দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের আগে ঋণের শর্ত পূরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি দল আসবে আগামী সেপ্টেম্বরে।
আইএমএফের ঋণ নিতে ছোট-বড় ৩৮টি শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। শর্তগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর্থিক খাতের মধ্যে আবার বড় অংশজুড়ে রয়েছে ব্যাংক খাত, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে দেওয়া শর্ত পরিপালনে নতুন পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের অর্থ রিজার্ভে আর দেখাতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক ধাক্কায় ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অবশ্য ডলারের
চাপ সামলাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন শুরু করেছে উভয় দেশ। তবু আমদানি-রপ্তানির এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এদিকে আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের আলোচনা শুরু হচ্ছে আগামী সেপ্টেম্বরে। তার আগে সংস্থাটির দেওয়া ৩৮ ধরনের শর্ত পরিপালন করতে হচ্ছে সরকারকে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ, জ্বালানির দাম বাড়াতে হয়েছে বারবার। যার প্রভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ দুই অঙ্কের ঘর ছুঁইছুঁই করছে। এ ছাড়া নতুন নিয়মে রিজার্ভ গণনা শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাজস্ব আদায় বাড়াতে নতুন করে পরিকল্পনা করেছে এনবিআর।
অন্যদিকে মার্কিন ডলারের অভাবে নিয়মিত গ্যাসের দাম পরিশোধ করতে পারছে না সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা। বিল বকেয়া রাখায় জরিমানাও গুনতে হচ্ছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়তে শুরু করলেও রিজার্ভ সে হারে বাড়ছে না। ১ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত জুন মাসের প্রথম ২৫ দিনে প্রবাসীরা ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই মাসের প্রথম ২৩ দিনে পাওয়া ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি। এতে চাপে থাকা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরছে। এদিকে নতুন অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে ৭২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা আগের অর্থবছরের লক্ষ্যের চেয়ে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার পর ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের রপ্তানি সম্ভব হয়েছিল। সে হিসাবে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রপ্তানি আয় আড়াই বিলিয়ন ডলার কম হয়।
জানা গেছে, আইএমএফ মিশনটি বাংলাদেশে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু, ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি ও ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা প্রবর্তন, প্রতিবছর ব্যাংকগুলোর খারাপ ঋণের তথ্য প্রকাশ, ব্যাংকের পুনঃতফসিল করা ঋণকে খেলাপি ঋণের হিসাবে আনা, বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলবে। এ ছাড়াও এই মিশন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, তাদের ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা, পুনর্মূলধন, খেলাপি ঋণের অবস্থা, তারল্য পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ব্যাংক কোম্পানি আইন ও ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন সংশোধন এবং দেউলিয়া আইন প্রণয়নসহ পাঁচটি আইন প্রণয়নের বিষয়ও খতিয়ে দেখবে।
বিশ্বের যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত কম, বাংলাদেশ তার অন্যতম। ফলে এ দেশে প্রয়োজনীয় খাতগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। ঋণের শর্ত হিসেবে কর আদায়ের কৌশল ঠিক করতে বলেছে আইএমএফ। এ ব্যাপারে সংস্থাটি কারিগরি সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর এ বিষয়ে এনবিআর কী করল, তা সংস্থাটির কাছে জানতে চাইবে মিশন।
এনবিআরের জন্য একটি বড় শর্ত হলো, শুল্ক-কর অব্যাহতির পরিমাণ কমানো। শুল্ক ও ভ্যাট বিভাগে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট চালু করাও আরেক শর্ত। এনবিআর সূত্র মতে, বর্তমানে বছরে এনবিআর গড়ে আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো কর অব্যাহতি দেয়। পর্যায়ক্রমে এই কর অব্যাহতি কমিয়ে সরকারের বিভিন্ন খাতে খরচ করার সামর্থ্য বৃদ্ধির পক্ষে আইএমএফ। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে ২০২৫-২৬ অর্থবছর নাগাদ তা শেষ করতে হবে। এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে তা-ও দেখবে আইএমএফ।
সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ০৩ আগস্ট ২০২৩