প্রশিক্ষণ ছাড়াই মিলছে বিএড সনদ
ঢাকা, ২২ডিসেম্বর- রাজধানীসহ সারা দেশে নামে বেনামে টাকার বিনিময়ে বিএড সনদ বিক্রি হচ্ছে। সরকারি বিধি নিষেধ থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান সমূলে উৎপাটন করা যাচ্ছে না। ফলে চাকরির আশায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী প্রতারিত হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের চিটাগাং রোডে মাদানী নগর এলাকায় মর্নিং সান কিন্ডার গার্টেন স্কুলের মালিক বলে পরিচয়দানকারী আইডিয়াল টিচার্স ট্রেনিং নামে অবৈধ কলেজের ব্যানারে আলী আজম এবং উত্তরার ১২নং সেক্টরের হামিদা আক্তার পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারে, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রের মাসুদ মাওলানা, দনিয়ার বর্ণমালা স্কুলে ফয়জুন্নেছা, ঢাকার আজিমপুরের মহানগর টিটি কলেজের হাকিম, চাঁদপুরের সেকান্দার টিটি কলেজ, জুরাইন হাইস্কুলের ইসমাইল, ভূলতা গোলাকান্দাইল বিদ্যানিকেতন কিন্ডার গার্টেনের মালিকখ্যাত আব্দুর রহিম দীর্ঘদিন ধরে তাদের স্কুলে বিএড সনদ বিক্রির রমরমা ব্যবসা করছেন।
বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের নাম ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে নিজেদের অবৈধ প্রতিষ্ঠানের নামে সরাসরি প্রসপেক্টাস ছাপিয়ে এই ধরণের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা।
সূত্রমতে, মিরপুরের ফজিলাতুন্নেছা টিটি কলেজ, ধানমন্ডির প্রাইম টিটি কলেজ, পল্লবীর শেরেবাংলা টিটি কলেজ, বিজয় নগর বধির স্কুলে পরিচালিত কলেজ অব এডুকেশন ও নীলক্ষেতের নিউ রাজধানী টিটি কলেজের মাধ্যমে এইসব প্রতারক চক্র বিএড সনদ বিক্রি করে।
এইসব অবৈধ কেন্দ্রে বিএড কোর্সে ভর্তি হলে ক্লাস, পরীক্ষা, টিচিং প্রাকটিস, লেসন প্ল্যান, এস্যাইনমেন্ট ও টার্ম পেপার কিছুই করা লাগে না।
২০১৯ সালের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়েরিতে প্রাইম টিটি কলেজের ঠিকানা ধানমন্ডিতে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে ধানমন্ডিতে এই কলেজের কোনো অস্তিত্ব নেই। হোন্ডায় হোম সার্ভিসের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ক্লাস, পরীক্ষা কিছুই লাগে না এখানে। ফাইনাল পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টারের রুম ভাড়া করে শুধু ভাইবা পরীক্ষাটাই নেয়। সেখানেও বাড়তি টাকা না দিলে ভালো নম্বর মেলে না। কেউ কলেজের মোবাইল নাম্বারে ফোন দিলে অধ্যক্ষ সাহেব বাহিরে আছেন বলে জানায়।
জানা গেছে, কলেজের অধ্যক্ষ মোজাহিদ মাওলানা জামায়াতের মাদ্রাসাখ্যাত যাত্রাবাড়ীর তামিরুল মিল্লাত মহিলা মাদ্রাসায় তার স্ত্রীর চাকরির প্রোক্সি দেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ সনদ বিক্রির অনেক অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও দনিয়া এলাকায় এলিট স্কুল এবং বর্ণমালা স্কুলের সহযোগিতায় অবৈধ বিএড সনদ বিক্রি করে আসছেন। প্রতিবেদকের কাছে তিনি মিরপুরের শেরে বাংলা টিটি কলেজের টিচার বলে দাবি করেন।
আরো জানা গেছে, তিনি কয়েক বছর আগে অবৈধ বিএড সনদ বিক্রির অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছেন কয়েক মাস। আর সনদ বিক্রি করবেন না মর্মে আদালতে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেও জেল থেকে বেরিয়ে ফের সনদ বাণিজ্য করছেন।
সূত্রমতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে ২ বছর আগে বন্ধ করে দেয়া রাজধানীর ফার্মগেটের বাংলাদেশ টিটি কলেজ অবৈধভাবে বিএড কোর্সের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে এখনও। রাজধানীর সাইক টিটি কলেজ ও ফজিলাতুন্নেছা টিটি কলেজ এসব অবৈধ ছাত্র-ছাত্রীর আশ্রয়স্থল।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্র এই কলেজের অধ্যক্ষ পরিচয়দানকারী জান্নাতুন নাহারের বিরুদ্ধে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিএড সনদ বিক্রির অভিযোগ করেন। তিনি জানান, টাকা দিলেই সব মেলে এই কলেজে।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার মন্নুজান বেগম বলেন, ‘আমরা অভিযোগ পাওয়ার পর পরিদর্শনপূর্বক আইনি প্রক্রিয়ায় এই কলেজটি বন্ধ করে দিয়েছি কয়েক বছর আগে। তারপরেও কলেজটি কীভাবে বিএড কোর্সে ছাত্র ভর্তি করায় তা আমার বোধগম্য নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব আমরা পালন করেছি এখন বাকি দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের।’
২০২০ শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী জানান, তিনি উত্তরার ১২নং সেক্টরের ৭৫ নং বাড়িতে অবস্থিত পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পর জানতে পারেন এটি অবৈধ বিএড সেন্টার। পরে ভর্তি বাতিল করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পরিচয় দিয়ে হামিদা আক্তার নামে এক মহিলা তাকে নানা রকম প্রলোভন দেখায়। ক্লাস পরীক্ষা ছাড়াই ফার্স্ট ক্লাস দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তাতে তিনি রাজি না হয়ে টাকা ফেরত চাইলে মাস্তান দিয়ে হুমকি দেন। পরে বাধ্য হয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
প্রাইম টিটি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাহিদ মওলানাকে একাধিকবার ফোন করলে তার সহকারী জানান তিনি বাইরে আছেন। কখন আসবেন জানেন না বলে ফোন রেখে দেন।
মর্নিং সান কেজি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আলী আজম বলেন, ‘বর্তমানে আইডিয়াল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অনুমোদন নেই। সুতরাং এর মাধ্যমে অন্য কোনো কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। তবে আমি জানি আপনাকে কে বা কারা এ বিষয়ে অভিযোগ করেছে। সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবে আপনি যে ইনফরমেশন পেয়েছেন সেটি সঠিক নয়।’
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরার ১২নং সেক্টরের পারসেপশন ক্যারিয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা হামিদা আক্তারের নাম্বারে কল দিলে নারী কণ্ঠের একজন জানান, আপনি যাকে চাচ্ছেন তিনি এখন নেই।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএড কোর্সের ডিন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনেক আগে থেকে ভুয়া টিটি কলেজ গজিয়ে উঠেছে। এগুলো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও শিক্ষক ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি, পরীক্ষা ও সার্টিফিকেট বিতরণ করে। আমরা নানাভাবে চেষ্টা করে অনেকগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। এদের কেউ কেউ আবার আদালতের নির্দেশ এনে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে।’
আরও পড়ুন : বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই : পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘বর্তমানে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এ কারণে সার্টিফিকেট বিক্রি করা সম্ভব নয়। কিছু টিটি কলেজ শিক্ষক ও অবকাঠামো ছাড়া চলছে। আমাদের কাছে তথ্য-প্রমাণ এলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে’ বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, টিটি কলেজের নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ থাকায় শিক্ষকদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিএড করার পরামর্শ দিয়ে থাকি। যেসব বৈধ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে কোনো সমস্যা নেই বলেও জানান তিনি।
সূত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল
আডি/ ২২ ডিসেম্বর