ইসলাম

মহররম মাসের আমল সমূহ

নতুন হিজরি বছর শুরু হয়েছে। দুনিয়ার সাধারণ নিয়মেই নতুন একটি বছর এসেছে পরিসমাপ্তির পথ বেয়ে। তাই এটি বিগত সময়ের মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করা এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন সংকল্পে উজ্জীবিত হওয়ার সময়। অতীতের যে সময়টুকু আল্লাহতায়ালার মর্জি মোতাবেক অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে, তার জন্য বিনম্রচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, আর যা উদাসীনতা, অলসতা ও আল্লাহর অবাধ্যতায় বরবাদ হয়েছে; সেজন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করা। এটাই হলো একজন প্রকৃত মুমিনের করণীয়।

ইসলামের শিক্ষা হলো মুমিনের আত্মপর্যালোচনা বর্ষকেন্দ্রিক নয়। মাস কিংবা সপ্তাহকেন্দ্রিকও নয়। মুমিন প্রতিদিন তার যাবতীয় কাজকর্মের হিসাব গ্রহণ করে এবং গতকালের চেয়ে আগামীকালকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। কারণ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সকল মানুষ প্রত্যুষে উপনীত হয় এবং নিজের সত্তাকে বিক্রি করে। হয় আল্লাহর কাছে বিক্রীত হয়ে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করে, নতুবা শয়তানের কাছে বিক্রীত হয়ে নিজেকে ধ্বংস করে।’ সহিহ মুসলিম : ১০০

সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেছেন, ‘যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত তখন প্রত্যুষের অপেক্ষা করো না। আর প্রত্যুষে করো না সন্ধ্যার অপেক্ষা। সুস্থতার সময়ই অসুস্থতার কথা মনে রেখে কাজ করো। আর জীবন থেকেই সংগ্রহ করো মৃত্যুর পাথেয়। হে আল্লাহর বান্দা! তুমি জানো না, আগামীকাল তোমার উপাধি কী হবে? (জীবিত না মৃত)।’ জামে তিরমিজি : ৪৬৮

হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররম। পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে এ মাস অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও সম্মানিত। কোরআনে কারিমের ভাষায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম এই মাস। আর এ মাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মহররমের দশ তারিখ। হাদিসে আশুরার দিনের অনেক ফজিলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব জাহেলি সমাজে এবং আহলে কিতাব ইহুদি-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।

উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, (জাহেলি যুগে) লোকরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, যে এ দিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। সহিহ বোখারি : ১৫৯২

বর্ণিত হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে, জাহেলি সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল, আলাদা মর্যাদা ছিল। যখন রাসুলে করিম (সা.) হিজরত করে মদিনা মোনাওয়ারা চলে আসেন দেখেন, মদিনার আহলে কিতাব ইহুদিরা এ দিনে রোজা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদযাপন করছে। নবীজি (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দিনে তোমরা কী জন্য রোজা রাখছ? তারা বলল, এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহতায়ালা এ দিনে হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (সমুদ্রে) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হজরত মুসা (আ.) এ দিনে কৃতজ্ঞতা আদায়স্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই আমরাও রোজা রাখি।

নবীজি (সা.) এ কথা শুনে বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজি (সা.) নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বললেন। সহিহ মুসলিম : ১১৩০

মহররম মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর আল্লাহর মাস মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’ সহিহ মুসলিম : ৩৬৮

মহররম মাসের রোজার মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি।’ সহিহ বোখারি : ২১৮

অন্য হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহতায়ালা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ সহিহ মুসলিম : ৩৬৭

আশুরার রোজা সম্পর্কে অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে আশুরার আগে বা পরে আরও এক দিন রোজা রাখো।’ মুসনাদে আহমদ : ২৪১

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব।’ সহিহ মুসলিম : ৩৫৯

ইসলাম মতে, আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে এ দিনের রোজা রাখা। সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদের রোজা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত নারী সাহাবি হজরত রুবায়্যি বিনতে মুআববিজ (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত খবর পাঠালেন, যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারা দিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোজা পূর্ণ করে। ওই নারী সাহাবি বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোজা রাখতাম এবং বাচ্চাদেরও রোজা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদের খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। সহিহ বোখারি : ১৯৬০

উল্লিখিত হাদিসগুলোর আলোকে ইসলামি স্কলাররা বলেন, মুমিন-মুসলমানদের উচিত মহররম মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। সেই সঙ্গে মহররম মাসে তওবা-ইস্তেগফারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াও আমাদের কর্তব্য।

ইসলামের বিধানে তওবা-ইস্তেগফার যেকোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। কোনো পাপের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা অথবা ভুলত্রুটি করলেই শুধু তওবা-ইস্তেগফার করবে এমন নয়। বান্দা সর্বদা আল্লাহর দরবারে ধরনা দেবে এবং নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে। তবে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন রয়েছে, যখন তওবার পরিবেশ আরও অনুকূল হয়। বান্দার উচিত আল্লাহর দেওয়া সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো লুফে নেওয়া এবং আল্লাহমুখী হয়ে জীবনকে আরও সুন্দর করা। মহররম মাস, বিশেষ করে এর ১০ তারিখ ‘ইয়াওমে আশুরা’ এমনই একটি উপযুক্ত সময়।

মহররম মাসের ফজিলতের একটি দিক হচ্ছে, এর সঙ্গে তওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তি, নিরাপত্তা এবং গায়েবি সাহায্য লাভ করার ইতিহাস জুড়ে আছে। এজন্য এ সময় এমনসব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরও বেশি ধাবিত হয়।

এক সাহাবি নবী করিম (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! রমজানের পর আপনি কোন মাসে রোজা রাখতে বলেন? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি যদি রমজানের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররমে রোজা রেখো। কেননা মহররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন এক দিন আছে, যেদিন আল্লাহতায়ালা (অতীতে) অনেকের তওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন। জামে তিরমিজি : ৭৪১

হাদিসের ব্যাখ্যাকারকরা এ দিনটি আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। ইসলামি স্কলারদের মতে, আশুরার ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে আল্লাহর রহমত ও নাজাত লাভের ইতিহাস, রয়েছে গোনাহ মাফের ঘোষণা তাই এ দিনে আল্লাহর রহমত লাভে তওবা-ইস্তেগফারের প্রতি খুব মনোযোগ দেওয়া। আর মুমিন তো রোজা অবস্থায় আল্লাহর রহমত লাভের অধিক প্রত্যাশী হয়।

আইএ

Back to top button