মুক্তমঞ্চ

হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল বৈঠকের গুরুত্ব

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

করোনাকালে আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা গত বৃহস্পতিবারের (১৭ ডিসেম্বর) হাসিনা-মোদি ভার্চুয়াল সামিট। এই শীর্ষ বৈঠকটি হওয়ার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে অনেক কুয়াশা কেটে গেল। ইদানীং কিছু ভারতীয় মিডিয়া এবং বাংলাদেশেরও একটি মহলের কৌশলী প্রচারণার ফলে দুটি প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কের ব্যাপারে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির সুযোগ দেখা দিয়েছিল। গত বৃহস্পতিবারের বৈঠক ও সমঝোতা সেই সন্দেহ দূর করেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বাইডেন নির্বাচিত হওয়ায় এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, পূর্বতন ওবামা প্রশাসনের আমলে ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে কেন্দ্র করে হাসিনা সরকারের সঙ্গে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের আমলে তা আবার দেখা দিতে পারে। সেই ধারণাটিও অমূলক বলে জানা গেছে ওয়াশিংটনের একটি ওয়াকিবহাল মহল থেকেই।

বিদেশ-নীতির ক্ষেত্রে হাসিনা সরকারের এখন কোনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ নেই। একমাত্র বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা সমস্যা। গত বৃহস্পতিবারের ভার্চুয়াল বৈঠকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার সে সম্পর্কেও আলোচনা হয়েছে। কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঢাকা ও দিল্লি একযোগে লড়াই চালাবে এবং অন্যদিকে রোহিঙ্গা সমস্যায় ভারত সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষ না নিলেও বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধানে মিয়ানমারকে রাজি করানোর জন্য ভারত চেষ্টা করবে- এই মর্মেও আশ্বাস পাওয়া গেছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মুজিববর্ষ উপলক্ষ করে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঢাকার বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম এবং দিল্লির জাতীয় মিউজিয়াম বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি এবং দু’দেশের ঐতিহ্য রক্ষায় যুক্তভাবে কাজ করবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আগেই জানিয়েছিলেন, এই ভার্চুয়াল বৈঠকে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্যে ঘাটতি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ করোনাভাইরাস মহামারিতে পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে। দুই প্রধানমন্ত্রী আগের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে এসব সমস্যা নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এই বৈঠকের সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর বাংলাদেশের চিলাহাটি থেকে ভারতের হলদিবাড়ি পর্যন্ত ৫৫ বছর পর আবার ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এই রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছিল। ফলে দুই দেশেরই বাণিজ্য ও লোক চলাচল ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

আরও পড়ুন ::

বৃহস্পতিবার সকালে দু’দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কৃষি, বাণিজ্য, জ্বালানিসহ সাত খাতে দু’দেশের সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই সমঝোতা স্মারক হচ্ছে কৃষি খাতে সহযোগিতা, হাইড্রোকার্বনে সহযোগিতার ব্যাপারে রূপরেখা, হাতি রক্ষায় অভয়ারণ্য তৈরি করা, নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের কার্যক্রমের সমন্বয়, হাই ইমপ্যাক্ট কমিউনিটি প্রকল্প চালু, বাংলাদেশ-ভারত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফোরামের টার্মস অব রেফারেন্স এবং বরিশালে স্যুয়ারেজ প্রকল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক।

চিলাহাটি ও হলদিবাড়ির মধ্যে ট্রেন চলাচল শুরু হলে বাংলাদেশের মোংলা বন্দর এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ নেপাল ও ভুটানের যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক বহুগুণ জোরদার হবে। ভার্চুয়াল বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহাত্মা গান্ধীর ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয় এবং দুই দেশের দুই জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এই উদ্বোধন উপলক্ষে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘এটা গর্বের বিষয় যে, আমি মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পারছি।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে একটি বিশেষ ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগের একটি স্ট্যাম্পের উদ্বোধন করা হবে।’

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বলে বিবেচনা করে ভারত। ভারতের কাছে অন্য কোনো দেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের মতো এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে হাইকমিশনার বলেন, ঋণচুক্তির আওতায় সারাবিশ্বে ভারত যে অর্থায়ন করে, তার ৩০ শতাংশ পায় বাংলাদেশ। যে শর্তে বাংলাদেশকে টাকা দেওয়া হয়, বিশ্বের আর কোনো দেশ এই সুবিধা পায় না। প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যত দ্রুত করা হবে, ঋণের টাকাও তত দ্রুত দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বহু সমস্যার শান্তিপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা হয়েছে। এর জন্য কৃতিত্বের প্রধান অংশ দাবি করতে পারে হাসিনা সরকার। ফারাক্কা চুক্তি, স্থল সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল চুক্তি, সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ, বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক চুক্তি ইত্যাদি বহু চুক্তি সম্পাদন দ্বারা শেখ হাসিনা দুই দেশের সম্পর্ককে এমন এক পর্যায়ে তুলে এনেছেন, সেখানে ফাটল ধরানো সহজ নয়। শেখ হাসিনার সবচাইতে বড় কৃতিত্ব, ভারতে কংগ্রেস সরকারের আমলে দুই দেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সূচনা, বিজেপি সরকারের আমলেও তিনি তা শুধু ধরে রাখ নয়, বহুগুণ বাড়াতে পেরেছেন। বিএনপি আমলের ভারত-বিদ্বেষ নীতির অনুসরণ নয়, বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করে শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা উপমহাদেশের জন্যই শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্র নিশ্চিত করেছেন।

অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, এশিয়ায় দুই বৃহৎ শক্তি ভারত ও চীনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য সমস্যা দেখা দেবে। শেখ হাসিনার সমন্বয়ের পররাষ্ট্রনীতি সে সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সাহায্যও কম নয়। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ছোট-বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মজবুত হওয়ার অন্যতম কারণ। গত ওবামা প্রশাসনের আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বিরূপ মনোভাবের ফলে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, মার্কিন প্রশাসন হাসিনা সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেবে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তুলে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট বাইডেন হোয়াইট হাউসে অবস্থান গ্রহণের পর বাইডেন এবং তার প্রশাসনের সঙ্গেও শেখ হাসিনা তার এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করে তুলবেন এ সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা যায়।

আরও পড়ুন : রাজধানীর সব ভাস্কর্য নিরাপদ রাখতে হবে: ডিএমপি কমিশনার

বাংলাদেশের এই সময়ের সবচাইতে বড় সমস্যা করোনা মহামারি এবং হিংস্র মৌলবাদীদের উত্থান। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুই দেশের যুক্তভাবে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারটি গত বৃহস্পতিবারের শীর্ষ বৈঠকে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু মৌলবাদীদের উত্থান সম্পর্কে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়েছে কিনা জানা যায়নি। মৌলবাদী উত্থানের সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও। ভারতে সন্ত্রাসবাদের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে এ সমস্যা অনেকটা দমন করা গেছে। এখন সমস্যা তথাকথিত ইসলামিস্টদের সমস্যা। ভারতের বিজেপি সরকার এই সন্ত্রাসীদের দমনের জন্যও সক্রিয়। এ ব্যাপারে দুই সরকারের মধ্যে কোনো সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের সমঝোতা প্রতিষ্ঠা সম্ভবত কষ্টকর নয়।

ভারত বাংলাদেশের সবচাইতে বড় এবং নিকট প্রতিবেশী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের রয়েছে বিরাট অবদান। বাংলাদেশ ও ভারতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা যেমন গঙ্গা, তিস্তার পানির ন্যায্য ভাগ চাই, তেমনি চাই রবীন্দ্রনাথসহ সমগ্র ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাপ্য অংশ। সাময়িক চুক্তি নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চুক্তিগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন দ্বারাই দুই দেশের সম্পর্ক স্থায়ী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লন্ডন, ১৮ ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২০২০

আডি/ ২০ ডিসেম্বর

Back to top button