অভিমত/মতামত

‘নারীকে কেন নাহি দিবে অধিকার’?

সেলিম জাহান

গত বছর ওর এক লেখায় শামীম লিখেছিল, ‘পুরুষ ব্যক্তিগতভাবে যতই অকেজো-অপদার্থই হোক, প্রচলিত প্রথার দ্বারা মেয়েদের শাসন করে আটকে রাখে নিজের স্বরূপ ঢেকে রাখার জন্যই’। ওর ওই লেখাটি পড়ে একটা প্রশ্নই অষ্টপ্রহর ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়েছে’ আমার সঙ্গে- ‘কেন পুরুষ প্রতিনিয়ত নারীকে শাসন করে, কেন অনবরত ভোগদখল করতে চায়, কেন বন্দী করতে চেয়েছে চিরায়ত কাল ধরে?’ কেন? কই, একজন পুরুষ তো আরেকজন পুরুষকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, যেভাবে সে একজন নারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তাহলে…?

আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই, জ্ঞানও আমার সীমিত। আমার মতামতকেও হয়তো একটি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বলে গ্রহণ করতে হবে। তবু আমার সীমিত বুদ্ধিতে মনে হয়, অন্তর্নিহিতভাবেই পুরুষের দেহজ গঠন, মন-মানসিকতা, অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক ক্রমধারার কারণেই পুরুষ নারীর প্রেক্ষিতে নিয়ন্ত্রক ও নির্যাতক হয়ে ওঠে।

প্রথমত: নারী যেখানে মনোবলে বলীয়ান, পুরুষ সেখানে দেহবলে বলীয়ান। এটাতো জানা কথা যে, দেহবলে বলীয়ান মানুষ তার পেশীশক্তি ব্যবহার করবেই এবং পুরুষ সেটা প্রতিনিয়তই করে। দেহবলই পুরুষকে উন্মত্ত করে, যুক্তি-বিবর্জিত করে, সংঘাতের দিকে টেনে নিয়ে যায়। দেহবলকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে পুরুষের মনে একটি অহংবোধের জন্ম নেয়।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে- নারীর মনোবল শক্তিশালী হওয়ার কারণে পুরুষের ঐ অহংবোধ ঠুনকো, ভঙ্গুর এবং খুব স্পর্শকাতর হয়। খুব অল্প কারণেই সে অহংবোধে আঘাত লাগে এবং তখন নারীকে শাসন করার সুতীব্র ইচ্ছা পুরুষ সামলাতে পারে না।

দ্বিতীয়ত: পুরুষ বহির্মুখী ও অস্থির, যেখানে নারী অন্তর্মুখী ও স্থির। পুরুষ ভাঙ্গতে চায়, নারী গড়তে চায়। পুরুষ ছুটে যেতে চায়, নারী ধরে রাখতে চায়। নারী যেখানে সবার কথা ভাবে, পুরুষ সেখানে বড় বেশী নিজের কথা ভাবে। স্বাভাবিকভাবেই সংঘাত সেখানে অনিবার্য। এ পুরো দ্বন্দ্বে পুরুষ নারীকে তার ইচ্ছে পূরণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখে। অতএব এমন বাধাকে তো শৃঙ্খলিত করতেই হবে পুরুষকে।

তৃতীয়ত: প্রথাগত ধারণার বিপরীতে বহু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী অনেক বাস্তববাদী ও যুক্তিনির্ভর। যেখানে পুরুষ অনেক বেশী স্বাপ্নিক ও আবেগপ্রবণ। সুতরাং পুরুষের অনেক অবাস্তব স্বপ্ন ও অপ্রয়োজনীয় আবেগ নারীর বাস্তববাদী যুক্তির ছুরিতে প্রায়শ:ই খন্ড-বিখন্ড হয়। এটা পুরুষকে ক্ষিপ্ত করে এবং তখন সে নারীকে বন্দী করার জন্যে ব্রতী হয়।

চতুর্থত: জীবনধারায় নারী পুরুষকে পরিপূরক হিসেবে দেখে, কিন্তু পুরুষ নারীকে দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। পুরুষের সমস্যা হচ্ছে- সে মনে করে যে, সে সর্ববিষয়ে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং তার অসাধ্য কিছু নেই। অন্যদিকে নারী জানে কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দূর্বলতা। নারীর দূর্বলতা পুরুষের পরিহাসের বিষয়, আর তার শক্তি পুরুষের অস্বস্তির কারণ। সুতরাং সম্পূরক হতে পুরুষের প্রবল আপত্তি।

পঞ্চমত: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে। ভোগের পণ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তার মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে, তাকে শাসনে রাখতে হয় অবাধ্যতা নির্মূল করার জন্যে, তাকে আটকে রাখতে হয়, যখন খুশী তখন ভোগ করার জন্যে।

নারীর ভেতরে একটি হীনমন্যতা বোধ সৃষ্টি ও আত্মবিশ্বাস গুঁড়িয়ে দেয়ার পরিবেশ পুরুষ সৃষ্টি করে নানান ভাবে। ঘরের মধ্যে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তা-ঘাটে, এক কথায় ঘরে-বাইরে, নারীকে পুরুষ উত্যক্ত করে পরিহাসমূলক কথার মাধ্যমে, ঈঙ্গিতময় তথাকথিত ঠাট্টার দ্বারা, তাদের শক্তিকে অবজ্ঞা করে এবং তাদের দূর্বলতাকে আঘাতের কেন্দ্র করে, কথার মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিনিয়ত খাটো করে। উচ্চকিত স্বরে তাদের বলা হয় যে, নারী বুদ্ধি-বিবেচনাহীন, তাদের কাজ মূল্যহীন, তারা দূর্বল ও সদা ক্রন্দসী। এ অসম্মানের ভার নারী বহন করে প্রতিক্ষেত্রে, প্রতিনিয়ত।

নারীর ভেতরে একটি ভীতির মানসিকতা ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের অবদমনের জন্যে পুরুষ ধর্ষণের মতো পন্থাও বেছে নেয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেহজ ধর্ষণই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু নারীকে শৃঙ্খলিত করার ক্ষেত্রে নানান ধরনের মানসিক ও সাংস্কৃতিক ধর্ষণও অবিরত ব্যবহৃত হয়।

শেষের কথা বলি। নারীকে অসম্মান করে পুরুষ বড় হয় না, সে আরো ছোট হয়ে যায়। নারীকে শৃঙ্খলিত করে পুরুষ বীর হয় না, তাকে মুক্ত করেই পুরুষ নমস্য হয়। নারীর অধিকার বিনষ্ট করে পুরুষ জয়ী হয় না, সে অধিকারকে নিশ্চিত করেই পুরুষ সম্মানিত হয়। তাই, পুরুষ হিসেবে আমাদের কাছে আমাদেরই জিজ্ঞাস্য, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার, হে পুরুষ?’

পুরুষ যদি সেটা না করে, তাহলে সে নিশ্চিত থাকতে পারে যে, নারীর কণ্ঠে সবলে উচ্চারিত হবে, ‘ শুধু শূন্যে চেয়ে রব, কেন নাহি চিনে লব নিজে, সার্থকের পথ?’

এম এন / ১১ অক্টোবর

Back to top button