মুক্তমঞ্চ

কী চায় আমেরিকা

আবেদ খান

আমি কয়েক বছর ধরে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেই চলেছি। কী চায় আমেরিকা? বাংলাদেশের ব্যাপারে আসলে তার উদ্দেশ্যটা কী? কী করতে চায় উপমহাদেশের এ অঞ্চলে তারা? কী মাস্টারপ্ল্যান? কোন মহাপরিকল্পনা এই উপমহাদেশ নিয়ে? কত বছর ধরে আঁটছে এই ফন্দি? কী ধরনের ছক কষছে এই শক্তিধর রাষ্ট্রটি? শুধু বাংলাদেশই কি তার লক্ষ্যকেন্দ্র বা সূচিমুখ? নাকি এই উপমহাদেশ? মনে মনে প্রশ্ন করছি—এটা কি ওই পরাশক্তির ভূ-রাজনীতির অংশ?

একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সরকার এবং প্রশাসনের সেই সময়কার ভূমিকা তো কারও বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। ভারত ও পাকিস্তানে তাদের প্রতিনিধিদের তৎপরতা, তাদের কূটনীতিকদের অপ্রয়োজনীয় দৌড়ঝাঁপ, গোপন বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধের বৈরী পক্ষের সঙ্গে শলাপরামর্শ এবং একসময়ে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি ভূমিকা নেওয়ার ব্যাপারটি তো বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের অবস্থানই স্পষ্ট করে দেয়। একাত্তরের ২৫ মার্চেই পাকিস্তানিদের মানবতাবিরোধী বীভৎস ধ্বংসলীলার সময় শুধু আর্চার ব্লাড আর তার কতিপয় অনুসারী ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল প্রচণ্ডভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি এবার তার জীবনের শতবর্ষ উদযাপন করতে চলেছেন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সহ্যই করতে পারতেন না। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি কি সামান্যতম বদলেছে? বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এলেই তাদের চোখমুখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়। এ দেশের অর্জনকে কত নেতিবাচকভাবে দেখা যায়, তার গবেষণা চলতে থাকে নিরন্তর। আর এ দেশের একশ্রেণির লোক আছেন; যারা মার্কিনিদের তথ্যের জোগান দেন। ‘‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’’ ভঙ্গিতে তোয়াজ করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। তাদের কাছে মার্কিন মুলুক হচ্ছে পৃথিবীর স্বর্গভূমি—সব পেয়েছির দেশ। বাংলাদেশ থেকে কোনোমতে সে দেশের একটা রেসিডেন্স পারমিট পেলেই যেন তাদের জন্ম সার্থক হয়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সঠিক কথাটিই বলেছেন। ভিসা নীতি আর কালোতালিকাভুক্তি নিয়ে তারা অধীর হয়ে যান এবং শঙ্কিতচিত্তে ভয়ের সংস্কৃতির বেসাতি বসান। কী অদ্ভুত দাস্যমনোবৃত্তি!

আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে সতর্ক করে বলেছেন—কী দরকার ভাই আমেরিকাকে চটিয়ে? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিই তো সকলের সঙ্গে সদ্ভাব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়। তাহলে—আমি তাকে বিনীতভাবেই বলেছি, অবশ্যই সঠিক। কিন্তু যে আমাকে ক্রমাগত আঘাত করেই যাবে, আমাকে ধ্বংস করার জন্য নিরন্তর চক্রান্ত করেই যাবে আর আমি পরম ধৈর্যের সঙ্গে তা সয়ে যাব, এটা কোন শাস্ত্রে আছে, ভাই? ভলতেয়ার বলেছিলেন, ধৈর্য অবশ্যই একটা মহৎ গুণ, কিন্তু তারও একটা সীমারেখা আছে; যা অতিক্রম করলে সেটা আর গুণ থাকে না।

এ কথা বলছি আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে। সম্মানিত পাঠক, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে, অর্থাৎ ধরা যাক, মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই কী মনোভাব ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসনের? এখন আমরা তারই একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরব।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে থেকেই এ দেশের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনের ষড়যন্ত্র ছিল। রাজধানীসহ সারা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় চালাল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ।

বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেই রাতের বিভীষিকার আংশিক চিত্র বিশ্ববাসী জানতে পারে লন্ডন টাইমস ও সানডে টাইমসে প্রকাশিত অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনে। ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানো এক জরুরি তারবার্তায় ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড পূর্ব পাকিস্তানে এ গণহত্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়ার মার্কিন নীতির সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সরকার ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নাগরিকদের জীবন রক্ষায় কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বাড়াবাড়িকে হালকাভাবে দেখছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে ও পূর্ব পাকিস্তানে নির্যাতন ও রক্তপাত বন্ধের আহ্বান জানিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বার্তা পাঠিয়েছেন, তখন আমাদের সরকার নৈতিক শূন্যতার প্রমাণ দিচ্ছে।…’ আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে নীতি পরিবর্তনেরও পরামর্শ দিয়েছিলেন আর্চার ব্লাড।

তখন ঢাকায় কর্মরত ২২ জন কূটনীতিক ও কর্মকর্তা এ তারবার্তায় সই করেছিলেন। এটি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পৌঁছানোর পর দক্ষিণ এশিয়া শাখার আরও ৯ কর্মকর্তা এতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এ ঘটনার আগে কখনো নিজেদের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এত কঠোর ভাষায় বার্তা পাওয়ার নজির স্টেট ডিপার্টমেন্টে ইতিহাসে নেই। ভারতের নয়াদিল্লিতে পদস্থ মার্কিন কূটনীতিক কেনেথ কিটিংয়ের কাছ থেকেও এসেছিল একই রকমের আহ্বান—নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রকাশ্য নিন্দা জানিয়ে অনতিবিলম্বে কঠোর বার্তা পাঠানো উচিত যুক্তরাষ্ট্রের। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার সেটা হয়নি।

স্বাধীনতার পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ওই বছর ১৮ মে হার্বার্ট ডি স্পিভাককে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় কূটনৈতিক মিশন শুরু করা হয়। এরপর ড্যানিয়েল ও. নিউবেরি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এ দেশে প্রথম মার্কিন র্যাঙ্কিং রাষ্ট্রদূত হিসেবে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে নিয়োগ পান ডেভিস ইউজিন বোস্টার (১৩ এপ্রিল, ১৯৭৪-১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬)। আনুষ্ঠানিক দায়িত্বপ্রাপ্তির পরই এই বোস্টার ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায় শুরু করে।

এরপর একে একে এ দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন এডওয়ার্ড ই মাস্টার্স (৫ নভেম্বর, ১৯৭৬-২৭ নভেম্বর, ১৯৭৭), ডেভিড টি স্নাইডার (২৯ মার্চ, ১৯৭৮-২৫ জুলাই, ১৯৮১), জেন অ্যাবেল কুন (১১ আগস্ট, ১৯৮১-৩ আগস্ট, ১৯৮৪), হাওয়ার্ড ব্রুনার শ্যাফার (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪-৯ জুলাই, ১৯৮৭), উইলার্ড আমেস ডি প্রি (৫ অক্টোবর, ১৯৮৭-১৭ আগস্ট, ১৯৯০), উইলিয়াম বি মাইলাম (১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯০-৯ অক্টোবর, ১৯৯৩), ডেভিড নাথান মেরিল (৫ এপ্রিল, ১৯৯৪-১৪ মে, ১৯৯৭), জন সি হোলজম্যান (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭-৬ জুলাই, ২০০০), মেরি অ্যান পিটার্স (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০০০-১৯ জুন, ২০০৩), হ্যারি কে টমাস জুনিয়র (১৪ আগস্ট, ২০০৩-২ জুলাই, ২০০৫), প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস (১৩ এপ্রিল, ২০০৬-২৩ জুন, ২০০৭), জেমস এফ মরিয়ার্টি (২১ এপ্রিল, ২০০৮-১৭ জুন, ২০১১), নিকোলাস ডিন (১৭ জুন-২৪ নভেম্বর, ২০১১ /চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স), ড্যান মজিনা (২৪ নভেম্বর, ২০১১-১২ জানুয়ারি, ২০১৫), মার্শা বার্নিকাট (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫-২ নভেম্বর, ২০১৮) এবং আর্ল আর মিলার (২৯ নভেম্বর, ২০১৮-২১ জানুয়ারি, ২০২২)। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস ১৫ মার্চ, ২০২২ থেকে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীকালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও এ দেশে তাদের তৎপরতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। মুখে যা-ই বলুক, বাংলাদেশ ইস্যুতে বরাবরই তারা একাত্তরের আগের নীতিই অনুসরণ করে আসছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে বিদেশিদের মধ্যে বেশি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরিবারের সদস্যসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান এবং তাদের দোসরদের উপেক্ষা করে মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে নিজের দেশকে স্বাধীন করে ১৯৭১ সালেই বঙ্গবন্ধু বিশ্ব নেতায় পরিণত হন।

১৯৭১ সালে শেখ মুজিবের কাছে শুধু পাকিস্তানই নয়, পরাজিত হয়েছিল খোদ যুক্তরাষ্ট্রই। কিসিঞ্জার একাত্তরের লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা ভুলতে পারেননি। পঁচাত্তরে জিয়া-মোশতাক চক্রের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যসহ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় কিসিঞ্জার-ভুট্টো চক্র। তাই তো মুজিব হত্যার পাঁচ দিনের মাথায় ২০ আগস্ট খুনি মোশতাককে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিহিংসাপরায়ণ কিসিঞ্জার এতটাই উল্লসিত হন যে, তিনি বলেছিলেন, ‘মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পেরে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন দলিল থেকে অকাট্য প্রমাণ মেলে যে, মোশতাক সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে কিসিঞ্জার রীতিমতো সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। খুনিদের প্রতিও যথেষ্ট সহানুভূতি দেখান তিনি।’ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সে দেশে বহাল তবিয়তে বাস করছে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত সাজাপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরী এবং কখনো কখনো যাতায়াত করছে মেজর ডালিম সম্ভবত কর্নেল রশিদও।

জানা যায়, ১৯৭৫ সালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ইউজিন বোস্টার মুজিব হত্যা-ষড়যন্ত্রে সরাসরিভাবে সক্রিয় ছিলেন। আর বাংলাদেশে মোশতাক, জিয়া, ফারুক-রশীদ চক্র তাদের বিদেশি প্রভুদের ভৃত্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিল। বোস্টার গং ঢাকায় খুনি চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িতই ছিল। এমনকি ১৫ আগস্ট ভোররাতে হত্যাযজ্ঞ চলাকালে ঢাকার রাজপথে বোস্টারকে তার গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। সোজা কথায়, হাজার মাইলের পথ সুদূর ওয়াশিংটন থেকে কিসিঞ্জার এবং ঢাকা থেকে বোস্টার মুজিব হত্যাকাণ্ড সরাসরি তদারকি করেছিলেন। বোস্টার ঘন ঘন বার্তা পাঠিয়ে ঢাকার পরিস্থিতি ওয়াশিংটনকে অবহিত করেন। মার্কিন দূতাবাস তাদের বার্তায় ঘাতক চক্র কর্তৃক বাংলাদেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যার মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা হত্যার পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না হওয়াটা ঢাকা থেকে প্রেরিত মার্কিন বার্তায় বারবার উঠে এসেছে। বোস্টার ওইদিন আরেকটি বার্তায়ও লিখেছে—‘ঢাকায় এখন বিকেল ৪টা। তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই অভ্যুত্থান সফল। রাস্তাগুলো শান্ত, লোক চলাচল খুবই কম, যানবাহন নেই বললেই চলে, দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল ছিল এবং রাস্তায় সেনা টহল রয়েছে।’

১৬ আগস্ট বোস্টার আরেক বার্তায় খন্দকার মোশতাককে আমেরিকাপন্থি হিসেব উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে দৃশ্যত যে দুজন বিদেশি উল্লসিত হন, তাদের একজন হলেন কিসিঞ্জার আর অন্যজন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো। স্বাধীনতার দুই বছর পর বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। তবে বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মোশতাকের অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘাতক সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় ভুট্টো।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে পিটার হাস ছাড়াও আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন উইলিয়াম বি মাইলাম, হ্যারি কে টমাস, প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, জেমস এফ মরিয়ার্টি, ড্যান মজিনা ও মার্শা বার্নিকাট। বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনে প্রকাশ্য ও নেপথ্যে নানাবিধ ভূমিকা রেখে প্রায় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন ছিলেন তারা।

বর্তমান পিটার হাস তো বাংলাদেশে পা রেখেই মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা এবং কখনো কখনো সীমা লঙ্ঘন করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি গত বছর বুদ্ধিজীবী দিবসে তিনি মায়ের ডাক নামক একটা সংগঠনের নেতার বাসায় গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইলাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার ও রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট। এখনো নানাভাবে আওয়ামী লীগবিরোধীদের বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা করেই যাচ্ছেন। ১৯৯০-৯৩ সালে এ দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের এত বছর পরও তিনি এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করছেন, কথা বলছেন। ২০১৪, ’১৮ এবং আগামী নির্বাচন ঘিরেও তার সক্রিয়তার খবর শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিএনপিকে পথও দেখিয়েছেন প্রভাবশালী এ মার্কিন কূটনীতিক। ’৯০ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সাক্ষীও তিনি।

১৯৯৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগ যখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করতে থাকে, তখন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় তৎকালীন বিএনপি সরকার। তখন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড এন মেরিল। কমনওয়েলথের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টেফানও তখন ঢাকায় এসেছিলেন দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক আপস-মীমাংসা করতে। বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেনও ঘটে এইসব কূটনৈতিক হস্তক্ষেপে। ২০০৭ সালে বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নির্বাচনের ১১ দিন আগে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে রাষ্ট্রপতি পদে তিনি বহাল ছিলেন।

উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি। এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা পর্দার আড়ালে যেমন ছিল, আবার সামনেও ছিল। এদের মধ্যে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান ছিলেন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। আরও সম্পৃক্ত ছিল কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত। বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তারা প্রায়ই বিবৃতি দিতেন।

একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘ প্রতিনিধি রেনাটা লক ডেসালিয়ান সতর্ক করে দেন, বাংলাদেশে যদি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, নানামুখী কূটনীতিক চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পথ তৈরি হয় এবং তার মাধ্যমে সেনা-সমর্থিত নতুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

এরপর অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত হয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তিনি রাজনৈতিক সমঝোতা করানোর জন্য ঢাকা সফর করেছিলেন। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় তারেক রহমানকে ভয়ংকর রাজনীতিক এবং দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতাসম্পন্ন সরকারের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবেও দেখেছিল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। বার্তায় তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। ২০১১ সালের ৩০ আগস্ট সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন মার্কিন নথি থেকে পাওয়া যায় এইসব তথ্য।

তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো—এই মরিয়ার্টিও কিন্তু পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ এবং নানাবিধ মিথ্যা অভিযোগ তোলার নেপ্যথ্যের নায়ক ছিলেন। উইকিলিকসে প্রকাশিত এক বার্তায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সততা নিয়ে ঢাকায় সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টির পুরোপুরি আস্থা ছিল না। চীনের সঙ্গে মন্ত্রী গভীর যোগাযোগ রেখে চলেন বলেও তারবার্তায় উল্লেখ করেন মি. মরিয়ার্টি।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার নানা তৎপরতাও ছিল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন। মজিনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতে পর্যন্ত যান। ভারত সফরে সে দেশের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কূটনৈতিক বৈঠকের পর বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের বিষয়ে দুই দেশের মতৈক্য হয়েছে বলে মজিনার বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ হয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ তো ক্ষুব্ধ হয়ে মজিনাকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ও বলেছেন।

পিটার হাসের আগে আর্ল মিলারও নানা তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। তার সময়েই র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মার্শা বার্নিকাট সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক এবং মার্কিন কার্যক্রমের অন্ধ সমর্থক বদিউল আলম মজুমদারের বাসা থেকে ফেরার পথে হামলার শিকার হয়েছিলেন। আর সেই মামলা এখনো চলছে। মার্শা বার্নিকাট তো নানা তৎপরতার কারণে এতটাই সমালোচিত হন যে, শোনা যায়, বিদায় বেলায় সরকারপ্রধানের সাক্ষাৎও তিনি পাননি। তবে সেই বার্নিকাট এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক নিযুক্ত হয়েছেন। গ্লোবাল ট্যালেন্ট পরিচালক হিসেবেও নিযুক্ত হয়েছেন।

নানা ঘটনার পরিক্রমায় ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কমতে থাকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা তথা তৎপরতা। বিগত দুজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঢাকায় শুধু রুটিন ওয়ার্কের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু এখন আবার সেই জায়গা থেকে সরে এসেছেন বর্তমান রাষ্ট্রদূত হাস। বিভিন্ন জায়গায় তিনি যাচ্ছেন। পরামর্শ দিচ্ছেন। আকাঙ্ক্ষার কথা জানাচ্ছেন। তার অর্থনীতি ও বাণিজ্যে দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সম্পর্ক নতুন মাত্রায় নেবেন, এমন আশা করা হলেও তিনি এখন রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

একটা বিষয় বোধহয় সবাইকে মানতে হবে যে, এ দেশটি কারও দয়ার দান নয়। এ দেশেরই আবালবৃদ্ধবনিতা প্রাণ বাজি রেখে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন; অনেক রক্ত, অশ্রু এবং ত্যাগের বিনিময়ে। কাজেই এ দেশ আর দেশের মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার অবকাশ কারও নেই। তা তিনি যে কোনো দেশের মানুষ বা প্রতিনিধিই যা-ই হোন না কেন।

আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই এবং কারও সঙ্গে শত্রুতা চাই না—এটা যেমন সত্য; তেমনি এটাও সত্য যে, আমরা চাই নিজেদের শর্তে জীবনযাপন ও বন্ধুতা। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এবং সেখানকার অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মানুষের লড়াই, জীবন-সংগ্রাম ও আত্মমর্যাদাকে ভালো চোখে দেখেছেন এবং দেখছেন, তাদের সেই অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়েই বলি, শত দুর্যোগেও পথ হারাবে না বাংলাদেশ।

আইএ, ০৭ জুন

Back to top button