ঢাকা, ০৬ জুন – মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসারে পর্যাপ্ত রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ সরকার। আর এ জন্য কর নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় মধ্যমেয়াদে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনকে কার্যকর, দক্ষ ও করদাতাবান্ধব করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। কর নিবন্ধন, রিটার্ন দাখিল ও কর প্রদান ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে এসব প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, সহজ ও করদাতাবান্ধব করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, তা যাচাই-বাছাই করে যৌক্তিকীকরণ করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অভ্যন্তরীণ ও আমদানি পর্যায়ে আদায়কৃত শুল্ক-কর এবং এ সংক্রান্ত নীতি যাতে স্থানীয় শিল্পের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখে তাও নিশ্চিত করা হবে। বিগত কয়েক বছরে সরকার কোভিডসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে, যা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তাই রাজস্ব আহরণ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে বাড়াতে না পারলে সরকারের পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান করা দুরূহ হবে। এজন্য আগামী তিন অর্থবছরে প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের প্রক্ষেপণ করেছে সরকার।
অর্থ বিভাগের করা মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সরকার আগামী ২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে চায়। এ অর্থের মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ লাখ ৫৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদে রাজস্ব পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার ৫ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণ করতে চায়। এ রাজস্বের বড় অংশ আসবে বিভিন্ন কর খাত থেকে। রাজস্ব আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এবং কর প্রদান সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট করলে অনেক কোম্পানি ও ব্যক্তি করদাতা কর প্রদানে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবে। ভবিষ্যতে রাজস্বের বড় অংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে।
কর-জাল বিস্তৃতকরণ ও রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমানে ব্যাপক কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তার হার যৌক্তিকীকরণ ও বাজেট প্রণয়নে আরও স্বচ্ছতা আনতে পদক্ষেপ নেবে সরকার।
রাজস্ব আহরণের দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের কর জিডিপি ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ভারতের ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ, ফিলিপাইনের ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ, ভিয়েতনামের ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং থাইল্যান্ডের ১৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
দেশের চলমান উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। মধ্যমেয়াদে সরকারের বিনিয়োগ ও ব্যয়ের যে পরিকল্পনা আছে, তা বাস্তবায়নে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চায় সরকার। এজন্য বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা ও ফাঁকির ক্ষেত্রসমূহ দূর করতে রাজস্ব ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। রাজস্ব আহরণে সক্ষমতা বাড়াতে না পারলে কাক্সিক্ষত পরিমাণ সরকারি বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে না। এজন্য কর ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এতে আগামীতে রাজস্ব আহরণ বাড়বে। এ জন্য রাজস্ব ব্যবস্থায় বিদ্যমান দুর্বলতা বিবেচনায় নিয়ে দেশের রাজস্ব আহরণের কৌশল নতুনভাবে তৈরি প্রয়োজন বলে দেশের মধ্য মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদে রাজস্ব পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়, রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক তা নির্ধারণ করার লক্ষ্যে বর্তমানে রাজস্ব আহরণ কম হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা হবে। বাংলাদেশে কাক্সিক্ষত পরিমাণের চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আহরণের পেছনে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, অনেক বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, কর অব্যাহতি, কাঠামোগত দুর্বলতা, জটিল কর ব্যবস্থাপনা ও তথ্য বৈষম্য এবং কর প্রদানে অনীহার সংস্কৃতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বেসরকারি অংশীজনদের সহায়তা নিয়ে সরকার কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করা, কর আইন সহজবোধ্য করা ও কর অব্যাহতি যৌক্তিকভাবে প্রদানের বিষয়ে নিবিষ্টভাবে কাজ করছে। রাজস্ব প্রশাসনে ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করা, কর আদায়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছ কর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা এবং প্রগ্রেসিভ কর ব্যবস্থা, যেখানে ধনী লোক বেশি কর দেবেন, এসবের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হলে রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম আরও সফল হবে। রাজস্ব খাতে চলমান ও প্রস্তাবিত সংস্কার কর্মসূচিসমূহ অভ্যন্তরীণ আহরণ বাড়াতে ও মধ্যমেয়াদে রাজস্ব লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রাজস্ব প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নানা ধরনের সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে এবং বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ লক্ষ্য পূরণ করা এনবিআরের জন্য এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজস্ব আহরণের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে, তা অর্জন করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। আগামী বাজেট নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও বলছে, রাজস্বের পরিমাণ বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি কমানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। চলতি বছরেও ৬০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। প্রযুক্তির মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা না হলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে না।
সূত্র: আমাদের সময়
এম ইউ/০৬ জুন ২০২৩