‘বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে মারা গেল’
নয়াদিল্লি, ০৩ জুন – ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ওড়িশা রাজ্যে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। দেশটিতে এ দুর্ঘটনাকে এই শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। দুটি যাত্রীবাহী ও একটি মালবাহী ট্রেন এই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। এতে এখন পর্যন্ত ২৬১ জনের নিহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেইসঙ্গে আহত হয়েছে ৯ শতাধিক। এর আগে দেশটির বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নিহতের সংখ্যা ২৮৮ জন জানানো হয়। খবর বিবিসির।
দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, শালিমার-চেন্নাই করোমান্ডেল এক্সপ্রেস ট্রেনটি বালাসোর জেলার কাছে লাইনচ্যূত হয়। এরপর এটি দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহী একটি ট্রেনকে ধাক্কা দেয় এবং এটির কয়েকটি বগি উল্টো-পাশের ট্রেন লাইনের ওপর গিয়ে পড়ে।
সেই লাইন দিয়ে আসছিল আরেকটি দ্রুত গতির যাত্রীবাহী ট্রেন- হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। এটি ইয়াশভান্তপুর থেকে হাওড়ার দিকে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনায় সেই ট্রেনেরও অনেক বগি উল্টে যায়।
বিবিসি দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় গ্রামবাসী এবং আহত যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে, যিনি করমন্ডেল এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করছিলেন। সুরিয়াবীর নামে এক ব্যক্তি জানান, আমার মা এবং দাদী ওই ট্রেনে ছিল। তারা ওষুধ কেনার জন্য শহরে গেছিল।
সুরিয়া জানান, দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই আমি আমার দাদীকে খুঁজে পাই। তিনি বেঁচে আছেন। কিন্তু আমার মা নিখোঁজ। আমরা তাকে প্রায় সবখানে খুঁজেছি কিন্তু পাইনি।
এ সময় কি করতে হবে আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না তাই আমার মায়ের একটি ছবি আমি আমার সব বন্ধুকে পাঠাই সেইসঙ্গে তার নাম্বার ও পড়নের কাপড়ের বিস্তারিত জানাই। এরপর আজ সকালে এক বন্ধুর কাছে আমার মায়ের সম্পর্কে জানতে পারি। তারা লাশের একটি ছবি পাঠিয়েছে- সেটি আমার মায়ের।
গিরিজা শংকর রাঠ নামে ওই ব্যক্তি জানান, মালবাহী ট্রেনটি একটি ভিন্ন লাইনে স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। করমন্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যূত হলো এবং এরপর মালবাহী ট্রেনটির সঙ্গে সংঘর্ষ হলো।
গিরিজা শংকর বলেন, তখন চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। অন্যদিক থেকে আসছিল আরেকটি যাত্রীবাহী ট্রেন শালিমার এক্সপ্রেস। এটি পেছন থেকে করমন্ডল এক্সপ্রেসকে ধাক্কা দিল। সেটির দুটি বগি লাইনচ্যূত হলো। এতে বিকট শব্দ হয় এবং সেইসময় চারিদিকেকেবল ধোঁয়া।
তিনি জানান, আমি লাইনের খুব কাছাকাছি ছিলাম এবং দৌড়ে দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা আটকে পড়া যাত্রীদের টেনে বের করা শুরু করলাম। আমরা কিছু যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলাম, কিছু মৃতদেহও বের করতে পারলাম।
গিরিজা শংকর বলেন, চারিদিকে যে কত আহত মানুষ। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে তাদের বের করবো। যখন উদ্ধারকর্মীরা এসে হাজির হলো, তখন কাজটা একটু সহজ হলো। সারারাত ধরে এই উদ্ধারকাজ চলেছে। আমার মাথা যেন এখনো ঘুরছে।
টুটু বিশ্বাস নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, আমরা একটা বিকট আওয়াজ শুনতে পাই। আমরা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে আসলাম, দেখি একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি দেখলাম মালবাহী ট্রেনটা আরেকটা ট্রেনের ওপর উঠে গেছে। এর পর আমি যখন দুর্ঘটনাস্থলে গেলাম, দেখি বহু মানুষ আহত, বহু মানুষ মারা গেছে। একটা ছোট্ট বাচ্চা কাঁদছিল। ওর বাবা-মা হয়তো মারা গেছে। এর একটু পর বাচ্চাটাও মারা গেল।
টুটু বিশ্বাস জানান, বহু মানুষ পানি চাইছিল। আমি যত মানুষকে দেওয়া সম্ভব, তাদের পানি এনে দিলাম পান করার জন্য। আমাদের গ্রামের মানুষরাও এখানে এসেছিল। তারাও যতটা সম্ভব মানুষকে সাহায্য করার চেষ্টা করলো। পুরো ব্যাপারটা ছিল খুবই ভয়ংকর।
মুকেশ পন্ডিত নামে আরেক যাত্রী বলেন, ট্রেনটা যখন ধাক্কা খেল, তখন আমি ট্রেনেই ছিলাম। এরপর ট্রেনটা লাইনচ্যুত হলো। একটা বিকট জোরে শব্দ হয়েছিল, তারপর ট্রেন উল্টে গেল। আমি ভেতরে আটকে পড়েছিলাম। আধাঘণ্টা পর স্থানীয় লোকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে।
তিনি বলেন, আমাদের সব জিনিসপত্র বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। আমি কিছুই খুঁজে পাইনি। আমি বেরিয়ে এসে মাটির ওপর বসে পড়লাম। আমার গ্রাম থেকে যে চারজন ওই ট্রেনে যাচ্ছিল, তারা বেঁচে গেছে। কিন্তু বহু মানুষ আহত হয়েছে। অনেকে এখনো নিখোঁজ। আমি ট্রেনের যে বগিতে ছিলাম, সেখানে অনেক মানুষ মারা গেছে। যারা গুরুতর আহত হয়েছিল, তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
সূত্র: আমাদের সময়
এম ইউ/০৩ জুন ২০২৩