দক্ষিণ এশিয়া

‘বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যিই কি বেঁচে আছি’

 

নয়াদিল্লি, ০৩ জুন – ভয়াবহ একটি রাত পার করল ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য। এ রাজ্যে কলকাতার হাওড়া-চেন্নাইগামী ট্রেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৯ শতাধিক। আর ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা।

করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ের কৃষ্ণপদ। কোনো মতে বেঁচে ফেরা এই কৃষ্ণপদ আনন্দবাজার পত্রিকাকে জানান তার ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, সত্যি বলতে কী, বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যিই কি বেঁচে আছি?

তিনি বলেন, কোয়েম্বত্তূরে কাকার সঙ্গেই মার্বেল পাথরের কাজ করি। কোয়েম্বত্তূরে কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। কাকার সঙ্গে টিকিট কেটেছিলাম স্লিপারে। এস-৪ কামরায় আমরা ছিলাম। কথা ছিল, শনিবার রাতের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছব। রোববার থেকেই তা হলে কাজে ফিরতে পারব। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কেমন ঘোলাটে লাগছে।

কৃষ্ণপদ বলেন, ওড়িশার বালেশ্বর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। বালেশ্বর স্টেশনে নেমে বোতলে জল ভরে নিই। নিজের আসনে না ফিরে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম দু-চার জনের সঙ্গে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে হঠাৎই বিকট একটা ঝাঁকুনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরা এক দিকে হেলে পড়তে থাকে। এস-৪ কামরা এতটাই কাত হয়ে যায় যে খোলা দরজা গলে বাইরে পড়ে যান দুই তিনজন। ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বুঝতে পারছি, আমিও হেলে পড়ছি খোলা দরজার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোহার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। আমি গিয়ে পড়ি সেই দরজার ওপর। এক মুহূর্ত আগে পড়লে আমিও ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যেতাম। কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি।

তিনি আরও বলেন, সেই সময় আরও কয়েকটি কান ফাটানো আওয়াজ শুনেছিলাম। জানি না কোথা থেকে আসছিল। বেশ কিছুক্ষণ মড়ার মতো পড়েছিলাম সেখানেই। তার পর শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। ততক্ষণে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেকেই দেখলাম মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দৌড়চ্ছেন আর চিৎকার করছেন, বাঁচাও, বাঁচাও। কী করব, কোথায় যাব কিছুই মাথায় আসছে না। সত্যি বলতে কী, বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যিই কি বেঁচে আছি?

কিছু ক্ষণ পর অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল। অনেকটাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুঝলাম, এস-৩ এবং এস-২ কামরা দু’টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের সংরক্ষিত কামরাগুলির আগে ছিল অসংরক্ষিত কামরা। ওই কামরাগুলোতে যে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে, ভাবতেও পারছি না। মাথা কাজ করছিল না। কাকার সঙ্গে আমিও নেমে পড়লাম উদ্ধারে। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে হাত নড়ছিল না। মুখ দিয়ে কথাও ফুটছে না। বাপের জন্মেও এমন দৃশ্য দেখিনি আমি। কাকারও একই অবস্থা। আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেওয়া।

ভারতের উড়িষ্যায় কলকাতার হাওড়া-চেন্নাইগামী ট্রেন করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়েছে। এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৯ শতাধিক। পূর্ব ভারতীয় রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তারা এটিকে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে মারাত্মক রেল দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। খবর রয়টার্স ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার।

ভারতীয় রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুক্রবার ওড়িশায় দুটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০৭ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ওড়িশার দমকল বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু সারঙ্গি রয়টার্সকে বলেছেন, এ পর্যন্ত ২০৭টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

উড়িষ্যা রাজ্যের মুখ্য সচিব প্রদীপ জেনা এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জানা যায়, সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বালেশ্বর স্টেশন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে বাহানাগা স্টেশনের কাছে ট্রেনটির সঙ্গে একটি মালগাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ট্রেনটির প্রায় ১৮টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ট্রেনের গতি বেশি থাকায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনটি মালগাড়ির উপরে উঠে যায়।

সূত্র: যুগান্তর
এম ইউ/০৩ জুন ২০২৩

Back to top button