ঢাকা, ২৯ মে – নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের লাইটহাউস প্রকল্পের পরতে পরতে নানা আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। চলতি অর্থবছরে কাজ শেষের ফিল্ডবুক না দিয়েই দুটি বিলে ৫ কোটির বেশি টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সামি কনস্ট্রাকশন। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হলেও ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা ক্যাশ রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। প্রকল্পের একজন দোভাষীকে মাত্র এক বছরে বেতন বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ টাকা। দোভাষী জসিম সেখকে প্রকল্পের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে এ টাকা দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞসহ নৌ পরিবহন সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পের এই ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন। এ ছাড়া সীমাহীন দুর্নীতিতে জর্জরিত এই প্রকল্পে অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামেও তোলা হচ্ছে বেতন-ভাতা।
‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ শীর্ষক প্রকল্পে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে অস্তিত্বহীন ব্যক্তির নামে ভৌতিক বেতন-ভাতা প্রদানের তথ্যও মিলছে। তবে এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দপ্তর এবং নৌ মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা মেলেনি। এমনকি মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের মৌখিক নির্দেশনা সত্ত্বেও তার দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করেননি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা ব্যয় হয়েছে এই প্রকল্পে। এর মধ্যে অনাবাসিক ভবন খাতে ব্যয় ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ টাকা। এই টাকার মধ্যে সামি কনস্ট্রাকশন দুটি বিলে ৩ কোটি ১১ লাখ ৪২ হাজার ৮০২ এবং ২ কোটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েছে; কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার ফিল্ডবুকের (সাইটবুক) কপি কমিটিকে দেওয়া হয়নি। অবশিষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে সিডিডিএল এবং স্পিডি গ্রুপ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে। তাই আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত তথ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের কথা বলা হলেও আপত্তিকৃত টাকার পরিমাণ ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০, যা প্রকল্প পরিচালক ব্যয় করেছেন। ক্যাশ রেজিস্টারে এ অর্থ লিপিবদ্ধ করা হয়নি।
২০১৪ সালে তিন বছরের প্রকল্প শুরুর পর দুবার সময় ও অর্থ বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্প নিয়ে বিস্তর অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন-২০০৬ এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮ যথাযথ অনুসরণ করা হয়েছে কি না, তা সরেজমিন অডিট করার জন্য চার সদস্যের অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি গঠন করা হয়। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্যে আহ্বায়ক করা হয় নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের পরিচালক (উপসচিব) বদরুল হাসান লিটনকে। সদস্য সচিব করা হয় একই সংস্থার স্পেশাল অফিসার মেরিন সেফটি ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. খায়রুল আলম সুমনকে। সদস্যরা হলেন অধিদপ্তরের সহকারী কেমিস্ট ফাওজিয়া রহমান ও সহকারী পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ। গত ২১ মে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে প্রতি পরতে পরতে।
এ প্রসঙ্গে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল জানান, পুরো প্রকল্পের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা অবগত। যারা দোষী তারা অবশ্যই শাস্তি পাবেন। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
উপকূল এলাকা থেকে গভীর সাগরের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে ৭টি লাইটহাউস ও সাতটি কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপনের প্রকল্প হাতে নেয় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাকায় একটি ১১তলা ভবন নির্মাণও রয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ বর্ধিত ব্যয় ৭৭৯ কোটি টাকা। তবে বাস্তবায়নে ধীরগতিসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তা খতিয়ে দেখতে নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (সদ্যবিদায়ী) কমডোর নিজামুল হক গত ১০ এপ্রিল চার সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন।
মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনের সূত্রমতে, নিরীক্ষা ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২৩ কোটি ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে। এর মধ্যে দোভাষীর বিল ছাড়াও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবু সাঈদ মো. দেলোয়ার রহমান নিজেই গত বছরের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক ব্যয় খাত হতে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৪০ টাকা নিয়েছেন। তবে এসব ব্যয় প্রকল্পের ক্যাশ রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করার তথ্য চাওয়া হলেও পিডির দপ্তর থেকে কমিটিকে তা দেওয়া হয়নি। এর ফলে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত নীতিমালা (পিপিআর)-২০০৮-এর ৫ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রকল্প পরিচালক দেলোয়ার রহমান বলেন, আমার কাজে স্বচ্ছতা আছে। নানা কারণে কাগজপত্র যথাসময়ে সরবরাহ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়ার কথা জানান তিনি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের সব বিল পাওয়া না গেলেও অপর্যাপ্ত বিলগুলো পর্যালোচনা করে অনেক অসংগতি মিলেছে। বিলগুলো পিপিআর-২০০৮, সরকারি আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রসহ সরকারি বিধিবিধান সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হয়নি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরের ভবন ও স্থাপনাসমূহ খাত থেকে মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড ও জুমাইমাহ ইন্টরন্যাশনাল (জেভি) নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ৫ কোটি ১৩ লাখ ১৯ হাজার ২৭৭ টাকা। গত বছরের ১৫ জুন মুন ভিউ ডেভেলপমেন্ট এই টাকা গ্রহণ করে। তবে নৌ মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ে এই বিলটি চাওয়া হলেও কমিটিকে দেওয়া হয়নি। এমনকি কাজ সম্পন্ন হওয়ার মেজারমেন্ট বুক চেয়েও পায়নি কমিটি। আরকেএস ট্রেডার্সকে ফি, চার্জ ও কমিশন খাত থেকে আলাদাভাবে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৬০০ টাকা ও ১ লাখ ৯৩ হাজার ৫২০ টাকা এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাত থেকে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭২০ টাকা দেওয়া হয়েছে। তবে তিনটি বিলের মধ্যে একটি পাওয়া গেলেও অন্য দুটি দেওয়া হয়নি কমিটিকে। এ ছাড়া মেরামত ও সংরক্ষণ খাতের আসবাবপত্র এবং ফিটিংস ও ফিক্সার উপখাত থেকে আলাদা দুটি টোকেনে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৩২৮ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই দরপত্র কোটেশন কমিটিতে পাট অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালককে রাখা হলেও নৌ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি নেওয়া হয়নি; কিন্তু এ-সংক্রান্ত চিঠিতে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ পিডিসহ প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভিন্ন ঠিকানায় আলাদা কার্যালয় রয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্রমতে, পেশাগত সেবা, সম্মানি ও বিশেষ হার খাতের কনসাল্ট্যান্সি উপখাত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন, বেটস কনসাল্ট্যান্ট এবং পাল্স কনসাল্ট্যান্ট—তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪০০ টাকা বিল পরিশোধ করা হয়েছে। বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে নকশায় নৌ অধিদপ্তরের অনুমোদনের শর্ত থাকলেও অনুমোদন নেওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পালস কনসালট্যান্টের বিলে সাইটবুকের তথ্য পায়নি কমিটি। এ ছাড়া পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী, একক উৎসভিত্তিক পরামর্শক নিয়োগে ফার্ম বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ লাখ বিল প্রদান করা যায়; কিন্তু উল্লিখিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের দুটিকে ২০ লাখ টাকার বেশি করে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া চলতি বছরের ১৯ মার্চ অনাবাসিক ভবন খাত হতে স্পিডি গ্রুপকে পরিশোধ করা হয়েছে ১ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৮৯১ টাকা। এসব টেন্ডার ইজিপিতে করার কথা থাকলেও বিলে তা করা হয়নি। আজকের প্রভাত ও দ্য ডেইলি আর্থ নামের দুটি অখ্যাত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সূত্রমতে, প্রকল্পের টাকা থেকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত আনোয়ার শিকদার ও মো. আনছার আলী নামে দুজন গাড়িচালকের নামে বেতন বিল উত্তোলন হচ্ছে। তবে বাস্তবে মো. আনছার আলী নামে কোনো চালকের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞসহ নৌ পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এসব ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন।
সার্বিক বিষয়ে পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল বলেন, একটি ছোট প্রকল্পে বাংলাদেশি একজন দোভাষীর মাসিক বেতন ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৫০ টাকা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে শুধু কালক্ষেপণই হচ্ছে না, প্রতিটি পর্যায়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি হচ্ছে।
সূত্র: কালবেলা
এম ইউ/২৯ মে ২০২৩