জাতীয়

আইপিএল জুয়ায় পাচার শতকোটি

শাহরিয়ার হাসান ও রানা আব্বাস

ঢাকা, ২৮ মে – বেটিং বা জুয়ার সহযোগী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে গত বছর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। সাকিব বাধ্য হয়ে সেই চুক্তি থেকে সরে এলেও ক্রিকেট নিয়ে দেশে জুয়ার বাজার রমরমাই আছে। আইপিএল নিয়ে অনলাইন জুয়া খেলার অভিযোগে গত মাসেই রাজশাহীতে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। ঢাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে রাজশাহীতে যৌথভাবে অভিযান চালানো হয়।

চলতি মৌসুমের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) ফাইনাল আজ রোববার রাতে। আইপিএলে যে দল চ্যাম্পিয়ন হবে, তারা পাবে ২০ কোটি রুপির (২৫ কোটি টাকা) প্রাইজমানি। যারা আজ হেরে যাবে কিংবা শিরোপার লড়াইয়ে থাকতে পারেনি, তাদের প্রাপ্তিও কম নয়। আইপিএল এখন কোটি টাকার মালিক হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে অনেক অখ্যাত ক্রিকেটারকেও। এ ছাড়া ক্রিকেট নিয়ে জুয়ার বাজারে বিপুল অর্থ হাতানোর সুযোগ পাচ্ছে সাধারণ দর্শকও। আবার এই জুয়ার নেশাই সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে অসংখ্য মানুষকে।

ঢাকায় কর্মরত একজন বেসরকারি চাকরিজীবী মাসিক বেতন থেকে টাকা সরিয়ে তিন বছর ধরে একটি ব্যাংকে জমিয়েছিলেন ৪ লাখ টাকা। গত জানুয়ারিতে পুরো টাকা হাতে পেলেও অনলাইন বেটিং সাইটে আইপিএল খেলায় লগ্নি করে এক রাতেই সব খুইয়েছেন। বেটিংয়ে টাকা খুইয়ে পরিচয় গোপন রেখে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) সাইটগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর আইপিএল খেলা ঘিরে অনলাইনে জুয়ার আসর বসিয়ে দেশে শতকোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে তাঁরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। চীন, রাশিয়া ও সাইপ্রাস—এই তিন দেশ থেকেই পরিচালিত অন্তত চারটি বেটিং সাইটের মাধ্যমে বিপুল টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সি (অনুমোদনহীন ভার্চুয়াল মুদ্রা) হয়ে বিদেশে পাচার হয়েছে। এ কাজে সহযোগিতা করেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পাঁচ শতাধিক এজেন্ট ও সাব-এজেন্ট।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ সুপার রেজাউল ইসলাম মাসুদ গত মঙ্গলবার বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার কারণে বেটিং সাইটে লেনদেন বেড়ে গেছে। অনলাইন বেটিং সাইটে আইপিএলসহ সব ধরনের জুয়ার ওপর সিআইডি নজর রাখছে। আইপিএল বা দেশের ক্রিকেট নিয়ে উত্তেজনা থাকেই। সেই সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে বেটিং চক্রগুলো। তাদের ফাঁদে পড়ে জুয়ায় অংশ নিয়ে সর্বস্বান্ত হন অনেক মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই মাঝবয়সী।

বেশি সক্রিয় চার সাইট
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আইপিএল জুয়ায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় চারটি সাইট হচ্ছে ওয়ানএক্সবেট, মোস্টবেট, বেট ৩৬৫, বেটউইনার নিউজ। সাইটগুলোতে সরাসরি আইপিএল খেলা দেখার সুযোগ আছে। সাইটে ঢুকে সেখানেই বলপ্রতি বা ম্যাচপ্রতি বাজি ধরছে দেশি জুয়াড়িরা। তার আগে অবশ্য অনলাইনে ওই জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে মোবাইল নম্বর বা ই-মেইলের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট ও ই-ওয়ালেট খুলতে হয়। সাইটে দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিং নম্বরে টাকা পাঠানোর পর তা ই-ওয়ালেটে যুক্ত হয়। সেখানে এই টাকার বিনিময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি পাওয়া যায়। তা দিয়ে শুরু হয় জুয়া।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপকমিশনার তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় বেশ কয়েকজন বেটিং সাইটগুলোর প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছেন। ডিবি কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অনেককে সতর্ক করেছে।’

জানা যায়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া ক্রিপ্টোকারেন্সির সংখ্যা এখন আট হাজারের বেশি। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিট কয়েন। বেটিং সাইটের ওপর নজর রাখা একাধিক সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সাইটগুলো পরিচালনা করা হয় দেশের বাইরে থেকে। তাদের হয়ে দেশে কমিশনের বিনিময়ে কাজ করেন দেশি এজেন্টরা। এই এজেন্টরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও গোপন লেনদেনের জন্য ব্যবহার করেন ম্যানেজমেন্ট ডক আইও নামের ওয়েবসাইট, টেলিগ্রাম ও রেড্ডি নামের কিছু অ্যাপ।

দিনে লেনদেন কয়েক কোটি টাকা
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার ও ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের মানি লন্ডারিং শাখা সূত্রে জানা যায়, অনলাইন বেটিং সাইট নিয়ে তাদের হাতে ছয়টি মামলা আছে। এসব মামলায় সম্প্রতি ৮-১০ জনসহ গত এক বছরে ১০৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সংস্থাগুলো। ডিএমপির ডিবির কাছেও আছে তিনটি মামলা। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আসামিরা ছাড়া পেয়ে পুনরায় অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের হাতেই চলছে এখন আইপিএল জুয়ার সাইট। অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের অভিযোগে গত বছর ওয়ানএক্সবেটবিডি ডটকম নামের রুশ বেটিং সাইটের ৯ বাংলাদেশি এজেন্টকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এ মাসে আইপিএল চলাকালে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এটিইউ।

আইপিএল-ছবি
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, সেই বেটিং সাইটের একজন এজেন্টের সিমে প্রতিদিন ১০-১৫ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য মেলে। প্রতিদিন একটি সাইটেই ৮-১০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। অন্য সাইটগুলোর চিত্রও এমনই।

সাইট বন্ধ করেও সুফল মিলছে না
সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে অনলাইন জুয়ার ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। গুগল প্লে স্টোর থেকে জুয়াবিষয়ক অ্যাপ সরাতে বিটিআরসি গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যাপ বন্ধ হয়েছে, বাকিগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে আমরা এসব সাইট বন্ধ করে দিচ্ছি। তবে যাঁরা এসব কাজ করেন, তাঁরা বিকল্প উপায় বের করে সাইটগুলোতে প্রবেশ করেন।’

মাঠে এবং টিভি বা মোবাইল ফোনে সরাসরি সম্প্রচার—এ দুইয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ২৭ থেকে ৩০ সেকেন্ড। এই ব্যবধানকে হাতিয়ার করেই জাল বিস্তার করছে ক্রিকেট বেটিং চক্র। এই কৌশল না জেনেই বহু ক্ষেত্রে আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হয়ে আরও বেশি টাকা জেতার তাগিদে ছুটছেন অনেকে। ডিএমপির ডিবি সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে জুয়া চলে এমন বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, অতিথিশালা, পার্ক, দামি হোটেলে পুলিশের নজরদারি আছে।

পুরোনো আইনে শাস্তি কম
দেশে জুয়া খেলা নিষিদ্ধ হলেও ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার ফল কিংবা অন্য কিছু নিয়ে ‘বাজি’ ধরে বিজয়ীকে অর্থ বা মূল্যবান বস্তু দেওয়ার চল আছে। তবে এই জুয়া সাম্প্রতিক কালে ডিজিটাল মাধ্যমে নতুন রূপ পেয়েছে। ঘরে বসেই মানুষ অনলাইনে বিভিন্ন জুয়ার অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছে। পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যেকোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা সহায়তাকারী তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

বিসিবির জিরো টলারেন্স নীতি
ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি এখনো কোনো বেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি বা নিজেদের ইভেন্টে অনুমোদন না দিলেও সরাসরি ‘অবৈধ’ও বলেনি। কারণ, একেক দেশে বেটিং নিয়ে একেক আইন। বাংলাদেশে অবৈধ হলেও অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে তা বৈধ। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ ওয়ানডে দল দক্ষিণ আফ্রিকায় যে সিরিজ জিতেছিল, সেটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল একটি বেটিং প্রতিষ্ঠান। তবে জুয়া নিয়ে বিসিবির অবস্থান ‘বিন্দুমাত্র ছাড় না দেওয়ার’। বিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী গত বুধবার বলেন, ‘আইন অনুযায়ী এটা আমাদের দেশে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, সামাজিকভাবেও স্বীকৃত নয়। আমাদের এখানে জিরো টলারেন্স অবস্থান। আমরা খেলোয়াড়দের এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত হওয়ার অনুমতি দিই না। নিজেদের কার্যক্রমের মাধ্যমে সবাইকে নিরুৎসাহিত করি। বিপুল রাজস্ব আসার সুযোগ করে দিলেও এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।’

সূত্র: আজকের পত্রিকা
আইএ/ ২৮ মে ২০২৩

Back to top button