ঢাকা, ১৯ মে – অতি মিহি ও সূক্ষ্ম কাপড় ঢাকাই মসলিন। বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ কাপড়টি ১৮৫০ সালে সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডন শহরে। এর প্রায় ১৭০ বছর পর আবার বোনা হয়েছে মসলিন শাড়ি। তবে অভিজাত কাপড়টি কিনতে সৌখিন ক্রেতাদের গুনতে হবে ৬ থেকে ১১ লাখ টাকা। কেননা একটি শাড়ি তৈরি করতে যে তুলার প্রয়োজন, সেটি উৎপাদনই সাড়ে ৪ থেকে ৮ লাখ টাকা পড়ে যায় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সরকারের উদ্যোগে একদল গবেষক ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিনকে ফেরানোর চেষ্টা চালান ২০১৪ সাল থেকে। কাপড়ের স্কেচ দেখে শুরু হয় পুনরুদ্ধার কার্যক্রম। এরপর বিশেষ তুলাগাছ সংগ্রহ, সুতা তৈরির প্রক্রিয়া, বুনন কৌশল আবিষ্কার করতে লেগে গেছে বেশ কয়েক বছর। বর্তমানে ঢাকাই মসলিনের কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলা দিয়ে নকশাবিহীন ১২ হাত কাপড়ের জন্য ২৭০ গ্রাম সুতা উৎপাদনে খরচ হয় ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ টাকা। প্রি উইভিং, পোস্ট উইভিং, বুননসহ নকশাবিহীন মসলিনের উৎপাদন খরচ পড়বে ৫ লাখ টাকার অধিক। মধ্যম নকশার একই পরিমাণের কাপড়ের জন্য ৩৫০ গ্রাম সুতা উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রি উইভিং, পোস্ট উইভিং, বুনন, নকশা, ফিনিশিংসহ মোট উৎপাদন ব্যয় হয় ৭ লাখ টাকা। এছাড়া ভারী নকশার ৫৫০ গ্রাম ওজনের একটি মসলিন শাড়ি উৎপাদনে ব্যয় হবে সাড়ে ৯ লাখ টাকার বেশি। এ নকশার একটি মসলিন শাড়ি বাজারে বিক্রি হবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায়।
গবেষকরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের কাঁচামাল ফুটি কার্পাস তুলা এক বিঘা জমিতে চাষ করে বছরে গড়ে ফলন পাওয়া যায় ৬০ কেজির মতো। আর বীজবিহীন এক কেজি তুলার মূল্য ১ হাজার টাকা। জমির ব্যবহার মূল্য, সার, সেচ, শ্রমিক, মাড়াইকরণ, জিনিং, ভূমি উন্নয়ন কর ইত্যাদি খরচ বাদে ফুটি কার্পাস তুলা চাষ করে বছরে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩৩ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। এদিকে দুজন তাঁতি দৈনিক নকশাহীন মসলিন কাপড় বুনন করতে পারেন চার ইঞ্চি, মধ্যম নকশার কাপড় দুই ইঞ্চি এবং ভারী নকশার মসলিন বুনন করতে পারেন দেড় ইঞ্চি। গবেষণায় উদ্ভাবিত ২১৫ গ্রাম ওজনের মধ্যম নকশার একটি মসলিন শাড়ি তৈরিতে সময় লেগেছে দীর্ঘ আট মাস। এতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ৭ লাখ ৯২ হাজার। আর ২২৩ গ্রাম ওজনের ১৮ ফুট লম্বা মসলিনের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা। সময় লেগেছে প্রায় সাত মাস।
মসলিন কাপড়ের কারণেই বিশ্বব্যাপী বিশেষ পরিচিতি পায় ঢাকা। মোগল আমলে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করা হয় ঢাকায় এবং বাদশাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগের সৃষ্টি হয়। মোগল বাদশাহ, নওয়াব, সুবেদার, রাজা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ধনী ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেরা ছিলেন মূল্যবান এ কাপড়ের বড় ক্রেতা। স্থানীয় অভিজাতদের চাহিদা পূরণ করে এক সময় তা বিদেশেও রফতানি হতো। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কেবল ১৭৪৭ সালেই রফতানি করা হয়েছিল ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার ঢাকাই মসলিন।
মূলত ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় উত্পন্ন তুলা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুতা তৈরি করে তা দিয়েই বোনা হতো মসলিন। আর কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে সূক্ষ্মতা আর দক্ষতা ফুটিয়ে তোলার যে জ্ঞান সেটা তাঁতিরা অর্জন করতেন অনেকটা বংশানুক্রমেই। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে ঢাকায় পা রাখা একাধিক পর্যটকের হাত ধরে মসলিনের খ্যাতি পৌঁছে যায় চীন থেকে রোম অবধি। সেখানকার সম্রাট আর রাজা-বাদশাদের উপঢৌকন হিসেবে সীমিত আকারে রফতানি হতে থাকে এ কাপড়। একইভাবে মসলিনের উন্নত ও অনুন্নত কিছু সংস্করণ সে সময় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছেও।
সম্প্রতি এক সেমিনারে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর বলেছেন, এক সময় এ দেশের তৈরি ঢাকাই মসলিনের সারা বিশ্বে কদর ছিল। বিভিন্ন কারণে প্রায় ১৭০ বছর আগে হারিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এটি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড বাস্তবায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য ও বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড ঢাকাই মসলিন পুনরুদ্ধার করে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তবে মসলিন শাড়ির দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমাদের চেষ্টা থাকতে হবে, বাণিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে মসলিনের স্বকীয়তা ঠিক রেখে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে এসে ব্যবহার উপযোগী করার। তবেই এ গবেষণা সম্পূর্ণ সফলতা পাবে।
সূত্র: বণিক বার্তা
এম ইউ/১৯ মে ২০২৩