কানের কাছে উঠতে বসতে মায়ের যে কথাগুলো বাজছে বার বার ,”তুই কবে আসবি? তাড়াতাড়ি আসবি তো? ”মনে হচ্ছে, মা কে ছেড়ে কেন এলাম? টানা ৬ মাস মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে একটা বিশেষ জরুরি কাজে কয়েকদিনের জন্য আমেরিকা এসেছিলাম,জরুরি কাগজপত্র নিয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসবো এমনটাই কথা ছিল , মা কে সেকথা জানিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে ফিরতে হবে তা ভাবিনি।
আমার এত বছরের জীবনে ততটা সময় কাটেনি মায়ের সঙ্গে ,যা গত বছরের অক্টোবর থেকে এবছরের এপ্রিল পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে আমার সময় কেটেছে অন্তরঙ্গতায়। এখানে আসার আগে প্রতিদিন টেলিফোনে আমার সঙ্গে গল্প করে ঘুমাতে যাওয়া মায়ের রোজকার রুটিন ছিল। মা বলতো ,সারাদিন ধরে অপেক্ষা করি তোর এই ফোনের জন্য। কোনোদিন ফোন করতে দেরি হলে বা না করলে (কদাচিৎ )মা ব্যাস্ত হয়ে পড়তেন ,আমার বন্ধু চন্দনা কে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। আমার অবর্তমানে যখন মা কে দেখার কেউ ছিল না ,চন্দনা মায়ের দেখাশোনা করা,ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে মায়ের সব ইচ্ছাপূরণ করত। মা বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে ওকে সঙ্গে নিয়েই যেত। মা ছিল আমার বিশেষ বন্ধু ,মায়ের সঙ্গে যত রাগ, ভালোবাসা, মান- অভিমান ,মনের কথা ভাগ করে নেওয়া একমাত্র মায়ের সঙ্গেই সম্ভব ছিল। একইভাবে মায়েরও আমি বন্ধু ছিলাম। গত অক্টোবরের শুরুতে ফোনে মায়ের গলাটা ভালো লাগেনি। আমার ডিসেম্বরে আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হল মায়ের কাছে এখনই যাবো ,মা কে চমকে দেব হঠাৎ। বুঝিনি নিজেই এভাবে চমকে যাবো। এরপর অক্টোবরে এসে এই প্রথম অনুভব করলাম মা ভীষণভাবে আমায় আঁকড়ে ধরতে চাইছে। কোনো ভয় ,অনিশ্চয়তা,একাকিত্ব মা কে গ্রাস করছে। দরজায় আমায় জড়িয়ে ধরে বলল ,”তুই এসেছিস ? আমায় ছেড়ে যাবি না তো ?”কোথায় মায়ের চোখে মুখে একটা ভয়ের ছাপ দেখেছিলাম সেদিন। বেশ কিছুদিন শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল মায়ের, বলল ,”আমায় একটা ডাক্তার দেখাবি ? বুকের বাঁ দিকে মাঝে মাঝে ব্যাথা করে খুব ”. এরপর ডাক্তার দেখানো হল। এত রোগ মায়ের শরীরে বাসা বেঁধে ছিল জানতাম না। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল ও তার চিকিৎসাও হল। সুস্থ করে নতুন বছরে 5th January মা কে বাড়ি নিয়ে এলাম। সব এঠিক ছিল। তারপর ছন্দপতন। শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক মানসিক কষ্ট নিয়ে মা চলে গেলেন যা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। সদাচঞ্চল , প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আমার মা যে এভাবে স্তব্ধ হয়ে যাবে ভাবিনি। আড়ালে চোখের জল ফেললেও ,ধৈর্য ধরে সব কষ্ট বুকে চেপে রেখে ,সবার সব দোষ তিনি আড়াল করে রাখতেন ,বিশেষ করে তার কাছের মানুষদের। মায়ের কাছ থেকে এটাও আমার শিক্ষা। দাদুকে,কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি ধারণ করেছিলেন। আষ্টেপৃষ্টে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তাঁর জীবনে বাঁচার অবলম্বন ছিল দাদুর কাজ ,গান ,তাকে নিয়ে গবেষণা। খুব ছোট বয়সে বাবা কে হারিয়েছি। একজন গৃহবধূ হয়ে কিভাবে সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ,অনেক অভাব অনটন কাটিয়ে মা তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে বড় করেছিলেন তা ঈশ্বর ই প্রতক্ষ করেছেন সেই সময়। শত কষ্টেও নিজের ও এই পরিবারের আত্মসম্মান খুইয়ে তিনি তাঁর বিত্তবান প্রকৌশলী বাবার আর্থিক সাহায্যও নেননি।যে সন্মান ,ভালোবাসা তিনি পরিবারের কাছে খুঁজেও পাননি,তা আপনারা,আপনাদের মতো তাঁর বহু সহৃদয় শুভাকাঙ্খী তাঁকে শ্রদ্ধা করেছেন ,অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছেন তাঁকে ,তাঁর গান ও তাঁর কাজকে।পশ্চিমবঙ্গ ,বাংলাদেশ ছাড়িয়ে প্রবাসের মানুষ তাঁকে যেভাবে ভালোবেসেছেন তা ছিল তাঁর কাছে অমূল্য। যে যখন যেখানে তাঁকে ডেকেছেন দাদুর কাজে ,মা নির্দ্বিধায় গেছেন ,মনের আনন্দে। দাদুর সৃষ্টিকে সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নাম ,যশ ,অর্থের প্রত্যাশায় মা কখনো কিছু করেননি।’বিষের বাঁশি ’মায়ের স্বপ্ন। এটি শুধু একটি গানের দল ই নয় , বিষের বাঁশির মেয়েরা ছিল মায়ের পরিবার। মা ছিলেন তাদের ”গুরুমা”…আমার অবর্তমানে .মায়ের ছাত্রীরা, সোমঋতা ও তার মা,চন্দনা ,প্রতিবেশী স্বপনদা, যারা মায়ের বাড়ির কাজকর্ম করতো এবং মায়ের প্রচুর ভক্ত -এরাই ছিল মায়ের পরিবার। মা উজাড় করে তার ভালোবাসা দিয়েছেন সবাইকে। পেয়েছেনও অনেক। কাজী পরিবারের ছোট বৌ ও প্রথম বৌ হিসেবে নিরলস অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সযত্নে লালন করেছেন তাঁর জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর পরিবারকে। রক্তের সম্পর্ক নয়,বাড়ির বৌ হিসেবে মা আগলে রেখেছিলেন সযত্নে এই পরিবারকে তাঁর ভালোবাসায় ,শ্রদ্ধায় এবং কাজের মধ্যে।
কোনো কাগজে মা কে নজরুল ইসলামের কন্যা হিসেবে সম্বোধন করায় মা আমায় উত্তেজিত হয়ে বলেছিল ,”আমায় কন্যা লিখেছে ,জানিস ,পরের জন্মে আমি নজরুল ইসলামের কন্যা হয়েই জন্মাবো ,দেখিস। আমি বলেছিলাম ,দাদুর তো কোনো মেয়ে ছিল না ,তুমি তো আসলেই দাদুর মেয়ে। মা বললো ,বলছিস তাই ? আমি বললাম সর্বৈব সত্য একথা।”
অনেক অভিমানে ,অনেক দুঃখ কষ্ট সঙ্গে নিয়ে মায়ের দেহ পৃথিবী ছেড়েছে কিন্তু মা আমার সঙ্গে আছেন এটা অনুভব করি। মায়ের শরীর অসুস্থ হলেও তাঁর মাথা সক্রিয় ও সজাগ ছিল। ডাক্তার সবসময় তাই বলতেন। মা সবকিছু বুঝতেন ,অনুভব করতেন অসহায়তায় কষ্টটা তাঁর তাই খুব বেশি ছিল।
যে কোনো অবস্থায় মা কে পাশে পেয়েছি ,অনেক সমস্যার সমাধান সহজে করে দিয়েছে ,অসম্ভব মনের জোর নিয়ে জীবনে অনেক লড়াই করেছে নিজে , হারতে শেখেনি , হারেনি। লড়াই করে বাঁচতে শিখিয়েছে আমায়। মা আমার সঙ্গে আমেরিকা চলে আসতে চেয়েছিল ,শরীর সাথ দেয়নি তাই শাহীন ও আমি আনতে পারিনি , মায়ের কবরের মাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। মা আমার সঙ্গে আছে। মায়ের জামাই শাহীন তাঁর এক বন্ধু ও প্রিয় মানুষ ছিল। তাকে বলেছিলো যে মা আমাদের কাছে আসবে। নিজের সন্মান নিয়ে ,কারোর গলগ্রহ হয়ে বাঁচতে চাননি মা কখনো। শেষের কটা দিন যেভাবে কেটেছে তা বোধহয় তাঁর প্রাপ্য ছিল না। শেষ কয়েকটা দিন আমেরিকা থেকে পরিবারের কাছ থেকে মায়ের কোনো খবর না পাওয়ায় মিডিয়ার মাধ্যমে মায়ের খবর পাই, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি , তিনি অবহেলায়, ফ্রি বেড এ পড়ে থাকা আমার অসহায় মায়ের শেষ খবর দেন..খুব অসহায় লাগছিল নিজেরও। ভাবছিলাম কেন মা কে ছেড়ে এলাম।
সবাইকে একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। কার কতদিন আয়ু তা আমরা কেউ জানি না। সেখানে বয়স কোনো বাধা মানে না। মা হয়তো চলে যেতেন কিন্তু মনে কোনো কষ্ট নিয়ে নয় , প্রকৃতির নিয়মে -এটাই চেয়েছিলাম। গত ৬মাসে যে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছি ২৪ ঘন্টা /দিন রাত একসঙ্গে , তা আমার জীবনের পরম সম্পদ। মা বলতেন , তোকে কিছু দিয়ে যেতে পারলাম না , আমার তো কিছু নেই , নিঃস্ব আমি। আমি বলতাম ,দিয়েছো তো ,নিজেকে ,উজাড় করে। মায়ের যত লেখা ,কাজ যত্ন করে আমার জন্য রেখেছিলেন ,আমার পরম সম্পদ সেগুলো। মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়ি 74 H Purna Das Road,(triangular park )তে দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা আর্কাইভ হবে , যেখানে তাঁর লেখা, তাঁর প্রকাশিত বই , স্বরলিপির বই,দাদুকে নিয়ে লেখা ভারত বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর যার লেখা যত বই এই আর্কাইভ এ থাকবে। থাকবে দাদুর ব্যবহৃত মূল্যবান সোনার দুটি পদক , অরিজিনাল ম্যানাস্ক্রিপ্ট ,দাদুর হাতে লেখা গানের খাতা , ঠাকুমার বিয়ের শাড়ি যা দাদুর দেওয়া ও আরো কিছু মূল্যবান জিনিস যা মা তাঁর বড় ছেলে কাজী অনির্বানের কাছে রাখতে দিয়েছিলেন।
তাঁর এই ইচ্ছাপূরণে ছায়ানট , বিষের বাঁশি এবং নজরুল ও আমার মায়ের অনুরাগীদের সঙ্গে চাই। আশা করি সঙ্গে পাবো। এই আর্কাইভের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা , নজরুল অনুরাগীরা তথা যারা নজরুলকে নিয়ে গবেষণা , চর্চা করছেন তারা উপকৃত হবেন। তিনি এই আর্কাইভের নাম ও ঠিক করে গেছেন। মা সবসময় বলতেন ,”আমার যে কাজগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল তা তুই শেষ করিস , দাদুকে নিয়ে যেমন কাজ করছিস দেশে বিদেশে সেটা কখনো ছাড়িস না ,দাদুকে,তাঁর কাজকে সবার কাছে পৌঁছে দিস তাঁর ও আমার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে।লেখা -গান -আবৃত্তি ছাড়িস না কখনো ,আমি তাহলে খুব কষ্ট পাবো।”. যোগ্য কিনা জানি না ,তবে মায়ের শক্তি ,তাঁর স্নেহ ভালোবাসা আশীর্বাদের ছোঁয়া পাই সবসময়। সেই বলে বলীয়ান হয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম। মা কে বলতাম ,মা তোমার শতবর্ষ পালন করবো। মা বলতেন ,এতদিন বাঁচবো কি ?জীবনে কখনো কোনো অবস্থাতেই যিনি আমায় ছাড়েননি ,সঙ্গী হয়ে পাশে থেকেছেন সব অবস্থাতে ,আজ তাঁর চলে যাওয়ায় সঙ্গীহারা অনাথ হলাম।
মা আছে আমার সঙ্গে আমার সব কাজে ,তিনি আমাকে দিয়ে তাঁর সব অসম্পূর্ণ কাজ ও ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেবেন , আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যখন শেষবারের মত মা কে দেখলাম তখন মায়ের নিথর দেহ ও মুখের দিকে চেয়ে শুধু মনে হচ্ছিল মা যেন বলছে —এত দেরি করলি কেন ,আর একটু আগে আসতে পারলি না ?কত অপেক্ষা করলাম তোর জন্য। মা যেন বলতে চাইছে –
“আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম ,প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরবিদায় নিলাম। যেদিন আমি চলে যাবো ,কত বড় বড় সভা হবে ,কত প্রশংসা বেরোবে আমার নামে। ….সেই শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধবাসরে বন্ধু তুমি যেন যেও না ,যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটা কথা স্মরণ করো। যদি মাটিতে পড়ে থাকা পায়ে পেষা একটা ফুল পাও,তবে সেটিকে বুকে নিয়ে বোলো ,”বন্ধু ,আমি তোমায় পেয়েছি। ”
মায়ের আহ্লাদী হতভাগিনী একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতা কাজী