জাতীয়

চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন পায়নি রেল, টাকা ছাড়ের চেষ্টা ঠিকাদারের

শাহেদ শফিক

ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর – ভবিষ্যতে যাত্রীসেবার মান বাড়াতে রেলওয়ের বহরে ২২০০ হর্স পাওয়ারের ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এজন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে চুক্তি হয় রেলওয়ের। এরইমধ্যে ইঞ্জিনগুলো দেশে আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন দেয়নি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২২০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের জন্য তিন হাজার কেভিএ জেনারেটর ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর সরবরাহের কথা থাকলেও তা হয়নি। জেনারেটরও দেওয়া হয়েছে ২২০০ কেভিএ জেনারেটর।

ইঞ্জিনগুলো তৈরিতেও অনুসরণ করা হয়নি দরকারি কারিগরি নির্দেশনা। আমদানি করার আগে সরাসরি পরীক্ষা করে যন্ত্রাংশগুলো গ্রহণ না করাতেই এই জটিলতা দেখা দিয়েছে। রেলওয়ে জানিয়েছে, একই স্পেসিফিকেশনে একই দেশ থেকে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরও ৬০টি ইঞ্জিন কেনার চুক্তি হয়েছে। সেই ইঞ্জিনগুলোও একইভাবে সরবরাহ করার চেষ্টা হতে পারে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন রেলের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এখনই ব্যবস্থা না নিলে কম মানসম্পন্ন যন্ত্রাংশ কেনাকাটার চক্রটি আরও শক্তিশালী হয়ে পড়বে।

রেলওয়ের ওই ১০টি ইঞ্জিন কেনাকাটায় কী ধরনের চুক্তি হয়েছিল এবং চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন সরবরাহ করা হয়েছে কিনা এসব বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত ১৮ অক্টোবর রেলের সচিব বরাবরে আবেদন করা হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রেলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (প্রকল্প) ও প্রকল্প পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করেন।

ওই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইঞ্জিনগুলো গ্রহণের আগে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে সিঙ্গাপুরের মেসার্স সিসিআইসি লিমিটেড নিয়োজিত ছিল। ইঞ্জিনগুলো জাহাজে তোলার আগে কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে কিনা সেই সার্টিফিকেটও দেওয়ার কথা। গত ২৫ জুলাই ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশের উদ্দেশে কোরিয়ায় জাহাজীকরণ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি লোকোমোটিভগুলোর কোনও প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন রিপোর্ট দাখিল করেনি রেলওয়েকে।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল : কৃষিমন্ত্রী

পরে প্রতিষ্ঠানটি ১২ আগস্ট সই করা দুই থেকে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে রেলওয়েকে দুটি মেইলের মাধ্যমে প্রি-শিপমেন্ট সার্টিফিকেটে পাঠায়। কিন্তু তাদের রিপোর্টে মূল কিছু যন্ত্রাংশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ছিল না। একই তারিখে দুই ধরনের সার্টিফিকেট ইস্যুর কারণে ওই সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রকল্প পরিচালকের সন্দেহ হয়। পরে প্রকল্প দফতর থেকে বারবার তথ্য চাওয়া হয়। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। এ অবস্থায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে গত ৩১ আগস্ট বন্দরে লোকোমোটিভগুলো চলে আসে। লোকোমোটিভ সরবরাহকারী বা পিএসআই কোম্পানির এমন অনিয়মের বিষয়টি প্রাথমিকভাবে ধরা পড়লেও রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রকল্প পরিচালককে ডেকে মালামালগুলো খালাসের জন্য মৌখিক নির্দেশ দেয়। ২ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হয়। এতে সন্দেহ আরও বাড়ে।

মো. শহিদুল ইসলাম ভূঁইয়া আরও জানান, এরই মধ্যে লোকোমোটিভগুলো চট্টগ্রামের পাহাড়তলি লেকো শেডে আনা হয়েছে। প্রতিটি লোকোর জেনারেটর, মডেল, কত কেভিএ বা ক্ষমতাসম্পন্ন সেই রিপোর্ট এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি রেলওয়ে। এ জন্য গঠিত কমিটি কাজ করছে।

সূত্র জানিয়েছে, সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তি অনুযায়ী লোকোগুলো সরবরাহ না করে নিম্নমানের ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে। এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও সরবরাহকারী কোম্পানিটি চুক্তিমূল্যের ৬৫ শতাংশ অর্থ ছাড় করিয়ে নিতে নানা চেষ্টা চালিয়ে চাচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ইঞ্জিন আমদানির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সেখানে মন্ত্রণালয়, রেল ও বুয়েটের প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। কিন্তু তারা এখনও প্রতিবেদন দেয়নি।

আরও পড়ুন : মনের দুঃখে শিশুটিকে মারছি : নেশাগ্রস্ত যুবক

জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, করোনার কারণে সময় মতো ইঞ্জিনগুলো আমদানি করা যায়নি। এ কারণে জাহাজীকরণের আগে ইন্সপেকশন করা যায়নি। তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানির লোকজন ছিল সিঙ্গাপুরে। তারা করোনার কারণে জাহাজীকরণের সময় উপস্থিত থাকতে পারেনি। দেশে এনে ইন্সপেকশন করার পর কিছু সমস্যার কথা জানান প্রকল্প পরিচালক (পিডি)। এজন্য আমরা একটা কমিটি গঠন করেছি। তারা কাজ করছে।

প্রতিবেদককে সরবরাহ করা ওই প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ইঞ্জিনগুলোয় টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা ছিল। যার কেভিএ জেনারেটরের হর্স পাওয়ার তিন হাজার হওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজন করা হয়েছে। যা পুরনো মডেলের। এর কেভিএ জেনারেটর ২২০০ হর্স পাওয়ারের। ফলে ইঞ্জিনের গতি (হর্সপাওয়ার) ও ব্যাকআপ সিস্টেম কম ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।

এরইমধ্যে ইঞ্জিনগুলোয় নানা ত্রুটি পেয়েছে এ সংক্রান্ত কমিশনিং কমিটি। কমিটি জানিয়েছে, চুক্তিপত্রবহির্ভূত ৩টি ক্যাপিট্যাল কমপোনেন্টসে ভিন্নতা আছে। সরবরাহ করা ইঞ্জিনগুলোতে ক্যাপিট্যাল-অলটারনেটর, ট্রাকশন মোটর সম্পূর্ণ ভিন্ন।

জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার জন্য কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা (৩৮ মিলিয়ন ডলার)। কোরিয়ার কোম্পানিটির বাংলাদেশি স্থানীয় এজেন্ট মেসার্স গোলাম মোস্তফা অ্যান্ড সন্স।

চুক্তিপত্র অনুযায়ী এরইমধ্যে ইঞ্জিন সরবরাহকারী কোম্পানিটি ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম বাবদ নিয়ে নিয়েছে। এখন বাকি ৬৫ শতাংশ অর্থ ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অর্থ পরিশোধ করা হলে ৯০ শতাংশ মূল্যই পরিশোধ হয়ে যাবে। এতে ইঞ্জিনের বিচ্যুতি পাওয়া গেলেও তা সংশোধনের উপায় থাকবে না।

অধিক গতিসম্পন্ন ইঞ্জিনগুলো পরীক্ষার জন্য দেশের রেললাইন উপযোগী নয়। কারণ, দেশে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৭২ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যায়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই ইঞ্জিনগুলো কেনা হয়েছে।

সুত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এ/ ১১ ডিসেম্বর

Back to top button