জাতীয়

প্রবল শক্তিতে আসছে ‘ মোকা’

ঢাকা, ১২ মে – ধীরে ধীরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’। ঝড়টির কেন্দ্র ও প্রান্ত মিলিয়ে ব্যাসার্ধ আস্তে আস্তে বেড়ে ৭০০ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। অনেক মেঘ ও বাতাস ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র ঘিরে ঘুরছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় এটি উত্তর দিকে অগ্রসর এবং ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। সম্ভাব্য এই ঘূর্ণিঝড় রোববার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের কিয়াউকপিউয়ের মধ্যবর্তী এলাকা দিয়ে উপকূল পার হতে পারে। তবে এর অগ্রভাগ আগামীকাল শনিবার রাতেই বাংলাদেশের উপকূল স্পর্শ করবে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর উত্তাল থাকায় দেশের সমুদ্রবন্দরগুলোকে ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উপকূলে বড় পরিসরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তবে দুর্গম উপকূলের মানুষ আছেন উৎকণ্ঠায়।

আগামীকাল শনিবার থেকে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় মোকার প্রভাব শুরু হবে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান। গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড়টি খুবই ধীরে ঘণ্টায় ৮ কিলোমিটার গতিতে এগিয়ে আসছে। ধীরগতির ঘূর্ণিঝড় কখনও শক্তি সঞ্চয় করে, আবার কখনও শক্তি ক্ষয় করে উপকূলে আঘাত হানে।

আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র মিয়ানমারের সিত্তুই ও কায়েকফু এলাকায় আঘাত হানতে পারে। তবে আমরা এতে ঝুঁকিমুক্ত নই। ঘূর্ণিঝড়ের অর্ধেক যেহেতু কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের অংশ দিয়ে যাবে, ফলে সেখানে ব্যাপক বৃষ্টি হবে।
তবে মোকা সুপার সাইক্লোন হতে পারে বলে গত বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। অবশ্য গতকাল আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, মোকার সুপার সাইক্লোন হিসেবে আসার আশঙ্কা দেখছি না। সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোমিটারের মতো বাতাসের গতিবেগ হতে পরে। স্বাভাবিক অবস্থায় ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার আর সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৫০ হতে পারে। মোকার অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় হওয়ার ইঙ্গিত আমরা পাচ্ছি।

আমেরিকার নৌবাহিনী পরিচালিত জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টারের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুসারে মোকা ঘণ্টায় প্রায় ১৭৭ কিলোমিটার বেগে উপকূলে আঘাত করতে পারে। তবে জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার অনুসারে কক্সবাজার উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের যে অংশটি অতিক্রম করতে পারে সেখানে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী থাকবে, ঘণ্টায় প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করবে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের বাতাস বয়ে যেতে পারে। ১০ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে দ্বীপটি। একইভাবে কুতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের ওপর দিয়ে ১০০ থেকে ১৩০ কিলোমিটারের বাতাস বয়ে যেতে পারে। কক্সবাজারের ওপর ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি আছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১২০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১‌৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল। মোকা আরও ঘনীভূত হয়ে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত উত্তর-উত্তর পশ্চিম দিকে এবং পরবর্তী সময়ে দিক বদল করে ক্রমান্বয়ে উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটার এর মধ্যে বাতাসের টানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়া আকারে ১১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে এবং গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।

ভারতীয় আবহাওয়া অফিস বলছে, ঝড়টি ধীর ধীরে বাঁক নিতে শুরু করবে এবং উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হবে। শুক্রবার তা আরও শক্তিশালী হয়ে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ পেতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ ড. সমরেন্দ্র কর্মকার বলেছেন, যে গতিপথ দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের মূল অংশ টেকনাফ ছুঁয়ে যাবে। হয়তো টেকনাফের একটু দক্ষিণ দিক অতিক্রম করে মিয়ানমারের দিকে চলে যেতে পারে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর মার্চ ও এপ্রিলে মধ্য ও উত্তর বঙ্গোপাসগরে কোনো নিম্নচাপ, লঘুচাপ বা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়নি। চলতি বছর প্রথম এই ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। সে কারণে পুরো মৌসুমের সূর্য থেকে আগত রশ্মি সবটাই বঙ্গোপসাগরের পানি উত্তপ্ত করেছে, ফলে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হয়েছে সাগরের পানিতে। কয়েক বছর ধরে যে কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, এর মধ্যে এই ঘূর্ণিঝড়টি সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার পানির মধ্যে। এখন বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার যে মানচিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে বুঝা যাচ্ছে, যত উত্তর দিকে ঘূর্ণিঝড়টি অগ্রসর হবে, তত বেশি এটি উত্তপ্ত পানির সংস্পর্শে আসবে। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়টি শক্তি ধরে রাখার জন্য যে তিনটি প্রধান শর্ত প্রয়োজন, তার তিনটিই আছে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে।
ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহন কুমার দাশ বলেন, বঙ্গোপসাগরের অনেকাংশজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩০-৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ধরনের উচ্চ তাপমাত্রা সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ সৃষ্টি করে, যা সমুদ্রে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম নিয়ামক।

কেমন প্রস্তুতি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়েছে। সারাদেশে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি ভবনে কন্ট্রোল রুম খুলেছে। এর মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়-সংক্রান্ত যে কোনো জরুরি সেবা ও সব ধরনের তথ্যসেবা পাওয়া যাবে। কন্ট্রোল রুমের নম্বর হচ্ছে– ০১৩১৮২৩৪৫৬০ এবং ০১৭৭৫৪৮০০৭৫। ঝড়ের গতি-প্রকৃতি ও সার্বিক অবস্থা বুঝে চলমান এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠক করেছেন। আগাম সতর্কবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। উপকূলীয় এলাকায় যত আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে, তা প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। সেখানে পাঠানো হয়েছে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে শেল্টার ম্যানেজমেন্টের জন্য ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর থেকে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তাতে ক্ষয়ক্ষতি শূন্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, ঈদগাঁও, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলায় ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে। উপকূল ও দুর্গত এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য অন্তত ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা প্রায় ৫ লাখ ৬ হাজার।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, দুর্যোগ সময়ের জন্য ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা, ৪৯০ টন চাল, ১৯৪ বান্ডিল ঢেউটিন, ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ছাড়তে শুরু করেছেন বাসিন্দারা। যারা এখনও বসতভিটায় রয়েছেন তারাও আছেন ভয়ে। টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাড়ে তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বরগুনার পাথরঘাটায় তিনটি মুজিব কেল্লা ও ৬৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় চার উপজেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং প্রায় সাত হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এ ছাড়া চার উপজেলাসহ ১৫টি উপজেলায় নগদ অর্থ এবং ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
নোয়াখালীর হাতিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় ৪৬৩টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বাগেরহাটের মোংলায় প্রস্তুত আছে ১০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র।

পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল গোলাম সাদেক বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় মোকা মোকাবিলায় পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করবে। ইতোমধ্যে জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনকে এ বিষয় অবহিত করা হয়েছে।

খুলনায় মোকা মোকাবিলায় প্রস্তুত করা হচ্ছে ৪০৯টি আশ্রয়কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে ২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। পটুয়াখালীর উপকূলীয় বা‌সিন্দাদের নিরাপ‌দ আশ্রয়ের জন্য ৭০৩‌টি আশ্রয়কেন্দ্র ও ৪০‌টি মু‌জিব‌ কেল্লাসহ সব প্রস্তুতি শেষ ক‌রে‌ছে জেলা প্রশাসন।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/১২ মে ২০২৩

Back to top button