শিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিষেধাজ্ঞা, তবুও চলছে জাল সার্টিফিকেটের রমরমা ব্যবসা

রিয়াদ তালুকদার

ঢাকা, ০৭ মে – একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। শিক্ষার্থী ভর্তিতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এরপরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র পাওয়া যাচ্ছে অবাধে। বিভিন্ন জালিয়াত চক্র এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে মিলছে অনলাইন ভেরিফিকেশনসহ জাল সার্টিফিকেট। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অনলাইন ভেরিফাইড সার্টিফিকেটেরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে চক্রটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি কুমিল্লার অনলাইন ভেরিফিকেশন করা প্রায় হাজার খানেক শিক্ষার্থীর হাতে চলে গেছে সার্টিফিকেট, মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র।

মঞ্জুরি কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি তাদের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষার্থী ভর্তিসহ একাডেমিক কার্যক্রম না চালানোর জন্য কমিশন থেকে নির্দেশনা রয়েছে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লা বিরুদ্ধেও অভিযোগের কারণে শিক্ষার্থী ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কোনও না কোনও অনিয়মের কারণে কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধের নির্দেশনা, শিক্ষার্থী ভর্তি কিংবা সার্টিফিকেট বিতরণের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর বৈধতা না থাকলেও অনলাইন ভেরিফিকেশনসহ জাল সার্টিফিকেট তৈরির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের মতো করে কাজ করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যখনই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে জাল সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়টি আমাদের কাছে আসে তখনই আমরা এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এসব বিষয়টি খুঁজে বের করে দোষীদের শাস্তির নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা হয়েছে জাল সার্টিফিকেট দিচ্ছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তারা কোনোভাবেই সার্টিফিকেট দিতে পারে না।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর রামপুরা ও লালবাগে অভিযান চালিয়ে জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র সরবরাহের অভিযোগে প্রতারক চক্রের চার সদস্যকে শুক্রবার (৫ মে) গ্রেফতার করা হয়। এরপরই জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে জাল সার্টিফিকেটের সঙ্গে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা। এরই মধ্যে গ্রেফতারকৃত চার জনই জাল সার্টিফিকেট তৈরি ও বিতরণের বিষয়টি গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কারা কারা জড়িত, সেরকম বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনতে কাজ করছেন গোয়েন্দারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সার্টিফিকেট, মার্কশিট ও প্রশংসাপত্র এতটাই সুক্ষ্মভাবে করা যে কেউ খালি চোখে সার্টিফিকেটটি দেখে বুঝতে পারবেন না এটি জালিয়াত চক্রের বানানো। সার্টিফিকেটের জলছাপ, স্ট্যাম্পের ছাপ সবগুলোই নিখুঁতভাবে করা। আর যখন সার্টিফিকেট অনলাইনে যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় তখন সেটিকে আর অসত্য বলার কোনও অবকাশ থাকে না। অনলাইন ভেরিফিকেশন করা এক একটি সার্টিফিকেট এক লাখ থেকে চার লাখ টাকা করে বিক্রি করতো।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, কোনও ধরনের ভেরিফিকেশন হবে না এরকম সার্টিফিকেট, মার্কশিট, প্রশংসাপত্রের জন্য প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে তারা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করে নিতো। দেশে-বিদেশে অনলাইনে ভেরিফিকেশন হবে, এরকম মার্কশিট-সার্টিফিকেট গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক থেকে চার লাখ টাকা করে নেওয়া হতো।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর নীলক্ষেতে ১৪ বছর ধরে একটি দোকানে কম্পিউটারের কাজ করতেন গ্রেফতারকৃত ইয়াসিন আলী। অবৈধ আয়ে নীলক্ষেতে বর্তমানে একটি দোকানের মালিক তিনি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা নীলক্ষেতে কাজের সূত্র ধরে তার সঙ্গে পরিচিত হন। এক পর্যায়ে জাল সার্টিফিকেট তৈরি এবং অনলাইন ভেরিফিকেশনের কাজে জড়িয়ে পড়েন ইয়াসিন। তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের নাম জানিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃত দম্পতি প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, তার স্ত্রী নুরুন্নাহার মিতু এবং দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি ডিরেক্টর বুলবুল আহমেদ দিপু ছিলেন মূলত গ্রাহক সংগ্রহের কাজে। গ্রাহক সংগ্রহের কাজ হিসেবে তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পড়তে যাওয়ার জন্য কনসাল্টেন্সি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে বসেন। সেখানে আসা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও কাগজপত্র কম থাকলে তা তারা বানিয়ে দিতেন। গ্রেফতারকৃত প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন বলে গোয়েন্দাদের তথ্য দিয়েছেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার স্ত্রী মিতু এসএসসি পাস।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ লালবাগ গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, যেসব জাল সার্টিফিকেট আমরা তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি সেসব বিষয় খতিয়ে দেখে আমাদের কাছে প্রতিয়মান হয়েছে তারা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জেনেছি এবং বেশকিছু নাম পেয়েছি। সেসব বিষয় বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ধরনের অপতৎপরতার সঙ্গে যাদের নাম আসবে তাদেরই আইনের আওতায় নিয়ে আসতে তদন্ত চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, এই চক্রের বেশ কয়েকজন বিজনেস ভিসায় বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে এর পেছনে অন্য কোনও বিষয় জড়িত রয়েছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তাদের পেছনে আর কারা কারা জড়িত এ বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে। মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ও খতিয়ে দেখা হবে।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আইএ/ ০৭ মে ২০২৩

Back to top button