অপরাধ

ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা মেরে পালিয়েছেন ব্যবসায়ী

ওবায়দুল্লাহ রনি

চট্টগ্রাম, ১০ ডিসেম্বর- জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা মেরে সপরিবারে লন্ডনে পালিয়ে গেছেন নাজমুল আবেদীন নামে তৈরি পোশাক খাতের এক ব্যবসায়ী। এ কারণে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) অবস্থিত তার দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চার ব্যাংকের আটকে গেছে ২৪৫ কোটি টাকা। এ অর্থ উদ্ধারের উপায় খুঁজছে ব্যাংকগুলো।

তবে এর মধ্যে কিছু ইউটিলিটি বিলের পাওনা আদায়ে খেলাপি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনাসহ মালপত্র ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করছে চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষ। এতে করে ব্যাংকগুলোর দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।

জানা গেছে, নাজমুল আবেদীন ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম ইপিজেডে এঅ্যান্ডবি আউটওয়্যার নামে একটি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরের বছরের শেষ দিকে স্ত্রী সোহেলা আবেদীন ও শ্বশুর একেএম জাহিদ হোসেনের নামে কিনে নেন নর্ম আউটফিট অ্যান্ড এক্সেসরিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে কোল্ড প্লে স্কুল প্রোডাক্ট নামে প্রতিষ্ঠা করেন আরেকটি কারখানা। তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে। এর মধ্যে এঅ্যান্ডবি আউট ওয়্যারের কাছে ব্র্যাক ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার পাওনা ১০২ কোটি টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট পাবে ৬০ কোটি টাকা।

এছাড়া নর্ম আউটফিটের কাছে ওয়ান ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ৫৪ কোটি এবং এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা পাবে ২৯ কোটি টাকা। এসব দায় সৃষ্টি হয়েছে ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে। এর বাইরে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে স্থানীয় সরবরাহকারীরা অন্তত ৫০ কোটি টাকা পাবেন বলে জানা গেছে।

নাজমুল আবেদীনের প্রতিষ্ঠানের কাছে বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ অন্যান্য ভাড়া বাবদ আড়াই কোটি টাকার মতো পাওনা দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষের। পাওনা আদায়ে প্রথম দফা গত ২৭ জুলাই সম্পত্তি বিক্রির জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয় বেপজা। তবে নিলামের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করে এনআরবিসি ব্যাংক।
আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করলে নিলাম কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আপিল বিভাগ ওই স্থগিতাদেশ রহিত করলে গত ২১ অক্টোবর পুনরায় নিলাম নোটিশ দেয় চট্টগ্রাম ইপিজেড। দ্বিতীয় দফা নিলামের দরপত্র প্রক্রিয়ার শেষ দিন ছিল গত ২৩ নভেম্বর। নিলামের সব প্রক্রিয়া শেষে এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সব মালপত্রসহ স্থাপনা হস্তান্তরে প্রক্রিয়া চলছে।

জানা গেছে, অর্থ উদ্ধারে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ব্র্যাক ব্যাংক। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা করে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চেক ডিজঅনারের অপর একটি মামলা করে ব্যাংকটি। এছাড়া ওয়ান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে এনআরবিসি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, গ্রাহক প্রতিষ্ঠান নর্ম আউটফিটের কাছে সুদসহ ব্যাংকের বর্তমান পাওনা রয়েছে ২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা। আর ব্যাংকের মূল্যায়নে, বেপজার ২০ হাজার বর্গফুটের স্থাপনার বাইরে প্রতিষ্ঠানটিতে ৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি এবং গুদামে তৈরি পোশাকসহ আরও প্রায় ২৫ কোটি টাকার মালপত্র রয়েছে। ব্যাংকের দেনার কোনো সুরাহা ছাড়াই পার্শ্ববর্তী কোরিয়ান একটি কোম্পানির কাছে বেপজা মাত্র ৭ কোটি টাকায় এসব মালপত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।

বক্তব্যের জন্য ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় থাকায় তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল আলমের বিস্তারিত জানা না থাকায় কিছু বলবেন না বলে জানান। নানা উপায়ে চেষ্টা করেও মার্কেন্টইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান কার্যালয়ের কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এনআরবিসি ব্যাংকের মামলার নথি থেকে জানা গেছে, গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের জানুয়ারিতে নর্ম আউটফিট অ্যান্ড এক্সেসরিজের নামে ২৫ কোটি টাকার ঋণসীমা অনুমোদন করে ব্যাংক। রপ্তানির অর্থ দেশে আনার সঙ্গে০ সঙ্গে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধের শর্তে ওই মাসের শেষ দিকে ২৫ কোটি ৪২ লাখ টাকার তিনটি ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়। তবে সময়মতো রপ্তানি না হওয়ায় ব্যাংকের তাগাদার ভিত্তিতে গত বছরের ১৪ মে অগ্রিম বাবদ এক কোটি ৮ লাখ টাকা সমপরিমাণ ডলার দেন গ্রাহক। পরবর্তী সময়ে গত বছরের ৩১ মে ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে তার মূল ডকুমেন্ট শাখায় জমা দেওয়া হয়।

দীর্ঘদিন পার হলেও রপ্তানির এক টাকাও ফেরত আনেননি গ্রাহক। ব্যাংকের তাগাদার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাহক নানা টালবাহানা করছেন। একপর্যায়ে গত বছরের ২২ আগস্ট শিপিং এজেন্টকে চিঠি দেয় ব্যাংক। শিপিং এজেন্ট জানিয়ে দেয়, সব মালপত্র ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ব্যাংক নিশ্চিত হয়, শিপিং এজেন্টের যোগসাজশে ব্যাংকের সিল-সই ও পি.এ. নাম্বার জাল করে নাজমুল আবেদীন নিজেই সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মালপত্র ছাড়িয়ে নিয়েছেন। এরপর প্রথমে উকিল নোটিশ এবং গত বছরের ৫ নভেম্বর ৬ জনের বিরুদ্ধে ডবলমুরিং থানায় মামলা করে ব্যাংক। পরবর্তীকালে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চেক ডিজঅনারের আরেকটি মামলা হয়। দুটি মামলায় নাজমুল আবেদীন এবং তার স্ত্রী ও শ্বশুর ছাড়াও আসামি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির জিএম জহির আহমেদ জামিল, কমার্শিয়াল ম্যানেজার মরিদুল হক রিপন ও ম্যানেজার মোবারক হোসেন টিটুকে। তাদের মধ্যে প্রথম তিনজন বিদেশে পলাতক এবং শেষের তিনজন জামিনে আছেন।

নিলাম প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের মহাব্যবস্থাপক মসিহউদ্দিন বিন মেসবাহ বলেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ভাড়া বাকি থাকায় নিলামের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকের কাছে দেনা থাকা অবস্থায় বেপজার নিলামের বিষয়ে আইনগত কোনো বাধা নেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল বাবদ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বেপজার পাওনার পরিমাণ জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

কে এই নাজমুল আবেদীন:

নাজমুল আবেদীন চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার মোস্তফা আনোয়ার হোসেনের ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইবিএ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে চাকরিতে যোগ দেন। কয়েক বছর চাকরির পর অনিয়মের দায়ে সেখান থেকে চাকরি হারালে চলে যান লন্ডনে। কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে তৈরি পোশাক ব্যবসা শুরু করেন। ব্যাংকে চাকরির সুবাদে ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়াসহ অনেক বিষয় খুব ভালো বুঝতেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন বলে জানান সংশ্নিষ্টরা। বাংলাদেশে তার ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের খুলশী এলাকার ৬ নম্বর রোডের বে গ্রিন ভ্যালি। নাজমুল আবেদীন বা এসব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ-সংশ্নিষ্ট কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সূত্র: সমকাল
আডি/ ১০ ডিসেম্বর

Back to top button