মুক্তমঞ্চ

ভাসানচর নিয়ে নয়, প্রত্যাবাসন নিয়ে ভাবুন

সৈয়দ আবুল মকসুদ

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় গ্রহণ পৃথিবীর অল্পসংখ্যক গণহত্যা ও নির্মম ঘটনার একটি। ১০ লাখ রোহিঙ্গা কী অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তা পৃথিবীর মানুষ সংবাদমাধ্যমে দেখেছে। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে, বাংলাদেশ কেন লাখ লাখ মানুষের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে পারল না। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক দুর্বলতা ছিল, সেটাও স্বীকার্য। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না যে মানবতাবোধ দেখাতে বাংলাদেশ সরকারের কিছুমাত্র ঘাটতি ছিল। আমরা সেই দেশের মানুষ, যে দেশের কবি কয়েক শ বছর আগে লিখেছেন: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।’ একদিকে মিয়ানমারের বর্বরতা, আরেক দিকে বাংলাদেশের মানবিকতা।

রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, তাদের ওপর নারকীয় নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে তাদের বসতভিটা থেকে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করার মূল্য রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারকে ততটা দিতে হয়নি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে দেশের বেসামরিক শাসক অং সান সু চি কিছুটা মূল্য দিয়েছেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া কিছু পদক–পুরস্কার–সম্মান তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ রকম বেইজ্জতি দুনিয়াতে বিরল। অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন।

বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন মানুষের সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী দেশগুলো, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো, মৌখিকভাবে বাংলাদেশের ‘পাশে’ থাকার কথা বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কিছু করেনি।

রোহিঙ্গা সংকট দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে আবদ্ধ থাকেনি। যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের আহ্বানে মিয়ানমার সরকারকে গণহত্যা–নির্যাতন বন্ধে চাপ দিতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেয়। আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে মিয়ানমারের গণহত্যা ও নির্যাতন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন মানুষের সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও শক্তিশালী দেশগুলো, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো, মৌখিকভাবে বাংলাদেশের ‘পাশে’ থাকার কথা বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কিছু করেনি।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৪০টি দেশের কূটনীতিকদের রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দেখানো হয়েছে। তাঁরা শরণার্থীদের মানবেতর অবস্থা দেখে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ইউনাইটেড নেশনস বা জাতিসংঘসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, হানাহানি, গৃহযুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রভৃতিতে সেসব সংস্থা বিবৃতি দেয় এবং ত্রাণ তৎপরতা চালায়। কখনো নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। তাতে কোনো ব্যাপারে আমেরিকা ও তার মিত্ররা যদি পক্ষে থাকে, চীন–রাশিয়া ভেটো দেয়। কখনো তার বিপরীতটি। তার ফলে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। অবশ্য এখন অনেক দেশে জাতিসংঘের বহুজাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান কে, তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও প্রভাব কতটা, তার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে। জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব সুইডেনের কূটনীতিক দাগ হ্যামারশোল্ড ষাটের দশকের শুরুতে কঙ্গোর কাতাঙ্গা সংকটে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধ থামাতে চারবার সেখানে যান। পঞ্চমবার যাওয়ার পথে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তখনকার উত্তর রোডেশিয়ায় (বর্তমানে জাম্বিয়া) নিহত হন। তাঁর সেই মৃত্যু তখন বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকা দাবি করে, কেজিবি তাঁকে হত্যা করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে, তাঁর বিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে সিআইএর লোক। পরে কেউ বলেছে, খনিজসমৃদ্ধ কাতাঙ্গা অঞ্চলের বহুজাতিক খনি কোম্পানিগুলোর ষড়যন্ত্রে তিনি নিহত হন। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পরে তাঁকে মরণোত্তর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। হ্যামারশোল্ডের মৃত্যুর পর তাঁর ডায়েরি–নোটবই প্রকাশিত হলে তাঁর অন্তর্জগৎ সম্পর্কে জানা যায়। ইংরেজ কবি ডব্লিউ এইচ অডেনের ভূমিকাসংবলিত তাঁর মার্কিংস (Markings) বইটি আমার প্রিয় পাঠ্য।

হ্যামারশোল্ডের পরে জাতিসংঘের মহাসচিব হন মিয়ানমারের নাগরিক উ থান্ট। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন মহাসচিব। তিনি নিরীহ ধরনের ভালো মানুষ ছিলেন, কিন্তু সাবলীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যা এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থী যখন ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়, তখন উ থান্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেননি।

ভৌগোলিক দিক থেকে আকারে ছোট অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেওয়ায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যে সমস্যায় পড়ে, তা চোখে না দেখেও কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব। তাদের তাৎক্ষণিক থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় কক্সবাজার জেলার পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আর কোনো দিনই পূরণ হবে না। বনভূমি তো উজাড় হয়েইছে, সামাজিক যে ক্ষতি হয়েছে, তা–ও অপূরণীয়। যেহেতু রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, তাই সরকার তাদের ভাসানচরে আপাতত থাকার ব্যবস্থা করে। সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে এক লাখ শরণার্থীর থাকার অবকাঠামো তৈরি করেছে। যারা সেখানে যেতে ইচ্ছুক, তেমন ১ হাজার ৬৪২ জনকে গত সপ্তাহে নেওয়া হয়েছে।

ভাসানচরে যারা গেছেন, তাঁরা কক্সবাজারের ক্যাম্পের চেয়ে যে অনেক ভালো আছেন, তা তাঁরাই স্বীকার করছেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে।

ভাসানচরে নির্মাণ করা হয়েছে ১২০টি গুচ্ছগ্রাম। তাতে ঘরের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪০। প্রতি ঘরে কক্ষ ১৬টি। প্রতি পরিবারের জন্য একটি করে। রান্নার জন্য ৮ পরিবারের একটি জায়গায় ৮টি চুলা। রয়েছে হাসপাতাল। সরকার তো রেশন দিচ্ছেই। ২২টি এনজিও সাহায্য সামগ্রী নিয়ে সেখানে গেছে।

প্রথম আলো এবং বিভিন্ন কাগজে গত রোববার ভাসানচরে মানুষের জীবনযাপনের ছবি ছাপা হয়েছে। অসহায় মানুষের অনেকের মুখেই স্বস্তির ছাপ। প্রথম আলোর রাহীদ এজাজের তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে চারটি শিশু। তাদের সবার মুখেই নির্মল আনন্দের হাসি। শিশুরা অভিনয় করতে জানে না। দুঃখের হোক, আনন্দের হোক, তাদের অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটে স্বতঃস্ফূর্ত। ভাসানচরে যারা গেছেন, তাঁরা কক্সবাজারের ক্যাম্পের চেয়ে যে অনেক ভালো আছেন, তা তাঁরাই স্বীকার করছেন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে।

আরও পড়ুন : বাবুনগরী-মামুনুলদের বিরুদ্ধে একদিনে দুই মামলা

ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের আপত্তি ছিল। তাঁরা যে যুক্তিই দিন, সাধারণ মানুষের ধারণা, শরণার্থীদের অসুবিধা না হলেও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের কিছু অসুবিধা হবে। সেখানে তাঁদের পাঁচতারা হোটেলে থাকার সুবিধা নেই।

রোহিঙ্গা সংকট একটি রাজনৈতিক সংকট। যেখানে রাজনীতি আছে, সেখানে নেতা থাকবেনই। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও অনেক নেতা দাঁড়িয়ে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের খুবই সখ্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিলে তাঁদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।

১১ লাখের মধ্যে লাখখানেক সরিয়ে নিলে পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হবে না। তা ছাড়া জন্মভূমি এবং নিজের বাড়িটি যদি কুঁড়েঘরও হয়, তার কোনো বিকল্প নেই। বিদেশ–বিভুঁইতে দালানকোঠায় থেকেও সে শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই সমস্যার সমাধান। ভাসানচর নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তাদের মাথা না ঘামিয়ে সেই চেষ্টা যদি তাঁরা করেন, তাতেই রোহিঙ্গা শরণার্থী ও বাংলাদেশের মানুষ তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক

আডি/ ০৯ ডিসেম্বর

Back to top button