পরিকল্পনাবিদ থেকে ফুটবল দুর্নীতির হোতা
ঢাকা, ১৫ এপ্রিল – নগর পরিকল্পনার ছাত্র ফুটবল দুর্নীতির মহাপরিকল্পনাকারী। পিকে হালদারের পর বুয়েট পেল আরেক আর্থিক কেলেঙ্কারির খলনায়ক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি হতে পারতেন নগর পরিকল্পনাবিদ। সেটা না করে ২০০৬ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে কম্পিটিশন্স ম্যানেজার হিসেবে। দেশের ফুটবলে তখন ঘোড় কলিকাল। তাই পেশা হিসেবে সেই চাকুরি মোটেই লোভনীয় কিছু নয়। তারপরও তিনি থেকে গেলেন কোনো এক অদৃশ্য কারণেই।
পনের বছর পর আজ ১৪৩০ বাংলা বছরের শুরুর দিনে জানা গেল কী কারণে বাফুফেতেই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন আবু নাঈম সোহাগ। ছাপোশা কম্পিটিশন ম্যানেজার থেকে ভাগ্যজোড়ে সোহাগের কাছে ২০১১ সালে চলে আসে বাফুফের নির্বাহী ক্ষমতা। প্রথম বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক আল মুসাব্বির সাদীর অকাল মৃত্যুর পর সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন সোহাগকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেন। পরের বছর থেকে তিনি পুরোদস্তুর সাধারণ সম্পাদক।
সেই থেকেই সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ট সহচর হয়ে ধীরে ধীরে মহীরুহ রূপ নেন সোহাগ। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করে অনিয়ম দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়ে ফেলেছিলেন বাফুফেকে।
অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে ফুটবল প্রশাসন করায়ত্ব করে নামে-বেনামে অসংখ্য সম্পদের মালিক হয়েছেন। সালাউদ্দিনের ব্যাংক চেক পেয়ে বছরের পর বছর ফুটবলের আয়-ব্যায়ে দিয়েছেন নিজের ইচ্ছে মতো। ক্ষমতার জোড়ে তিনি সরকার ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে ছাড়েননি।
তবে এত সুখ তার সইলো না। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ফিফার তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে সোহাগের কুকীর্তির ঘটনা। শুক্রবার বাংলা বছরের প্রথম দিনে সোহাগের চাকচিক্যময় জীবনে নেমে এসেছে অমানিষার অন্ধকার। ফিফা তাকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ভুয়া বিল-ভাউচার স্থাপন ও মিথ্যে তথ্য দেওয়ার অভিযোগে।
শান্ত-সুবোধ, স্বল্পভাষী সোহাগের কপালটা খুলে যায় ক্যানসারের কাছে আল মুসাব্বির সাদী হেরে যাওয়ায়। সালাউদ্দিন প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েই রানিং মেট হিসেবে বেঁছে নেন তুখোর ক্রীড়া সাংবাদিক আল মুসাব্বির সাদীকে। ভীষণ প্রতিভাবান সাদী যতদিন নির্বাহী দায়িত্বে ছিলেন, ততদিন কক্ষপথেই ছিল বাফুফে। সালাউদ্দিনও হাটছিলেন সঠিক পথে।
সাদীর অকাল মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন সাধারণ সম্পাদকের শূন্য পদের জন্য যোগ্য কাউকে না নিয়ে বেঁছে নেন সোহাগকে। অথচ ফুটবল প্রশাসন চালানোর সেই যোগ্যতাই সোহাগের ছিল না। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে দুইবার ফিফার এডমিনিস্ট্রেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট ইন্সট্রাকটর কোর্সে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। অথচ তার সঙ্গেই বাফুফেতে মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেয়া প্রয়াত আহমেদ সাঈদ আল ফাত্তাহ প্রথম প্রচেষ্টায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রিজিওনাল ইন্সট্রাকটর হন।
সোহাগ অবশ্য নির্বাহী ক্ষমতা হাতে পেয়ে শুরুতেই চক্রান্ত করে ‘পথের কাটা’ ফাত্তাহকে সরিয়ে দেন বাফুফে থেকে। এরপর থেকেই শুরু তার রাম রাজত্ব। সোহাগের নিষিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে বাফুফের একটি বড় পদে চাকুরি করে পরবর্তীতে সোহাগের অন্যায়ের শিকার হয়ে চাকুরি হারানো এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সাত-আট বছর আগেই তার অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিলাম। একটি আন্তর্জাতিক ইভেন্টে অংশ নিতে বাফুফে সভাপতি ও সোহাগের সঙ্গে আমারও বিদেশ সফরে যাওয়ার কথা ছিল। সোহাগ আমাকে বলেছিল, বাফুফে ভবনে আসার পথে মতিঝিলের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে তিনজনের টিকিট সংগ্রহ করে নিয়ে আসার জন্য। আমি সেই ট্র্যাভেল এজেন্সিতে যাওয়ার পর সেখানকার লোকজন সোহাগকে ফোন করে জানতে চায়, বিলে কত টাকা বাড়িয়ে লিখবে। সোহাগ ফোনে প্রতি টিকিটে ২০০ ডলার করে বাড়িয়ে বিল বানাতে বলে। এভাবেই প্রতিটি ক্ষেত্রে সোহাগ দুর্নিতির আশ্রয় নিয়েছে। সারা বছর সকল কেনাকাটা নিজের হাতে রেখে কমিশন বানিজ্য চালিয়েছে সে দীর্ঘদিন যাবৎ। বন্ধুদের নাম ব্যবহার করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ফুটবল কেন্দ্রীক ব্যবসা পরিচালনা করে সোহাগ। এ সব কিছুই বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দীর্ঘদিন করেছে সে। অথচ বাফুফে সভাপতি জেনেও না জানার ভান করে থেকেছে।’
ক্ষমতার জোড়ে সোহাগ হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে পড়েছিলেন এক পর্যায়ে। তার আর্থিক অনিয়ম-দুর্নিতির বিষয়টি ছিল ফুটবল অঙ্গনে ওপেন সিক্রেট। ফুটবলের মানুষদের অনেকেই তার নাম দিয়েছিলেন মিস্টার ১০ পারসেন্ট। অর্থের নয়Ñছয়ের পাশাপাশি বেতনভুক্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়া সত্যেও কাজী সালাউদ্দিন যাতে ক্ষমতায় থাকেন, সে জন্য নানা কুকীর্তির আশ্রয় নিতে দেখা গেছে সোহাগকে।
চলতি মেয়াদের আগের মেয়াদে সোহাগ বাফুফের প্রয়াত সহ-সভাপতি বাদল রায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ব্যপক সমালোচিত হয়েছিলেন। অসুস্থ বাদল রায়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করেন। এ নিয়ে গোটা ফুটবল অঙ্গন উত্তাল হয়ে উঠলেও সোহাগকে শাস্তি না দিয়ে উল্টো চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দেন সালাউদ্দিন। একই সঙ্গে বেতনসহ নানা সুযোগ সুবিধাও বাড়ানো হয়।
সোহাগের বিরূদ্ধে প্রায়ই ওঠা নানা অভিযোগ লহমায় উড়িয়ে দিয়ে সালাউদ্দিন বারবারই তাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন। সোহাগের ঢাল হয়ে তিনি সংবাদ মাধ্যমকেও ফুটবলের শত্রু তকমা দিয়েছেন নির্দ্বিধায়। এমনকি ফিফা সোহাগের বিপক্ষে তদন্ত শুরু করার পরও সালাউদ্দিন বাফুফের পক্ষ থেকে কোনরকম ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাটেননি। উল্টো কী করে তাকে বাঁচানো যায় সেই ফন্দি এঁটেছেন।
গত ফেব্রুয়ারির একটা ঘটনায় হাজারো কুকর্মের কারিগর সোহাগের প্রতি সালাউদ্দিনের রহস্যময় অন্ধ বিশ্বাসের নজির মিলেছে। ফেব্রুয়ারিতে সোহাগ বাফুফেতে তার অধস্তন তিন কর্মকর্তাকে নিয়ে গোপনে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফা সদরদপ্তরে গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নিতে। যাওয়ার আগে কয়েক রাত সোহাগ তার কুশিলবদের নিয়ে অবৈধভাবে অনেক রাত পর্যন্ত বাফুফে ভবনে অফিস করেন। কঠোর গোপনীয়তার বিষয়টি অবশ্য প্রকাশ্যে চলে আসে দৈনিক দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে।
পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাদের গোপন সফরের খবর। এ নিয়ে তুলকালাম শুরুর পর সালাউদ্দিন দাবী করেন, ‘সোহাগসহ চার অফিসিয়াল ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত খরচে জুরিখ যান। তাদের জুরিখ সফরের খরচ বাফুফে নয়, তবে অন্য কেউ বহন করেছেন।’
ভীষণ শক্তিমান সোহাগ বাকি তিনজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন মূলত ফিফার জেরার মুখে যাতে তালগোল পাকিয়ে না ফেলেন, সেই সুবিধার্থে। চার অফিসিয়াল ফিরে আসার পর সোহাগকে পাশে বসিয়ে সালাউদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে কথা বলেছেন, তাতে বোঝাতে চেয়েছেন তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যে।
সম্প্রতি সাফজয়ী নারী ফুটবল দলকে মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাইপর্ব খেলতে পাঠাতে না পারার দায় সোহাগ দেন সরকার ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে। দল মিয়ানমারে পাঠানো বাবদ ৯২ লাখ টাকার চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়কে দিয়েছিল বাফুফে। সেখানে বিভিন্ন খাতে বাজেট বাড়িয়ে দেখানো হয়। চাহিদাপত্র দেয়ার দু’দিন পর সরকার টাকা দিতে ব্যর্থ দাবী করে সংবাদ মাধ্যমে ভিডিওবার্তা দেন সোহাগ।
এ নিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে ক্রীড়াঙ্গন। খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত মেয়েদের না পাঠানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর জন্য সরকারকে দায়ী করা বেজায় ক্ষেপে যান ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। সোহাগ এবং সালাউদ্দিনের ঔদ্ব্যর্তপূণপ্র্য বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করায় বাফুফের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সুপারিশ করে।
তারপরও থামেনি সোহাগের মুখ। নিজের সিদ্ধান্তকে অকাট্য প্রমাণে মিথ্যে-বানোয়াট বক্তব্য দিতে শুরু করেন। পদত্যাগ করবেন কি না- এমন প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে দুই দিন আগেও বড় বড় কথা বলতে শোনা গেছে। তবে কোন কিছুতেই আর পিঠ বাঁচলো না আলোচিত সোহাগের।
দেশকে ফাঁকি দিলেও ফিফার জালে ঠিকই ধরা পড়তে হলো সোহাগকে। ফুটবল থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন সোহাগ। তাতে দেশের ভাবমূর্তিতে আরেকবার পড়েছে কলঙ্কের কালীর ছটা। এবার প্রশ্ন, তাকে লালন-পালন করে চারাগাছ থেকে মহীরূহে রূপান্তরিত করা সালাউদ্দিন কতদিন পারবেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে? চার মেয়াদে ফুটবলকে তিনি নিয়ে গেছেন ধ্বংসের দ্বাড়প্রান্তে। সোহাগের জারিজুড়ি ফাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ডানহাতটা কাটা পড়েছে সালাউদ্দিনের। এবার নিজেকে কিভাবে রক্ষা করবেন বাফুফে বস?
সূত্র: দেশ রূপান্তর
আইএ/ ১৫ এপ্রিল ২০২৩