বিস্তৃত স্রোতস্বিনী করতোয়া কি বিলুপ্তির পথে
অপরিণামদর্শী নদীশাসনে রুদ্ধ পানিপ্রবাহ। দূষণে ব্যবহার অনুপযোগী নদীর পানি। তীর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একের পর স্থাপনা। এক সময়ের বিস্তৃত-স্রোতস্বিনী করতোয়া এখন অস্তিত্বের প্রবল সংকটে। শীর্ণ-ক্ষীণকায়া নদীটির বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন তীরবর্তী বাসিন্দা, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মীরা।
তিন দশক আগেও করতোয়ার প্রবাহ ছিল তুলনামূলক স্বাভাবিক। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর করতোয়ার প্রবেশমুখ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থানার খলসী চাঁদপুরে স্লুইস গেট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, ওই সময় থেকে বগুড়া অংশে নদীটি দ্রুত ভরাট হতে থাকে। বাড়তে থাকে দখল-দূষণও।
সরজমিনে দেখা গেছে, খলসী চাঁদপুরের স্লুইস গেটটিতে এখন পানিপ্রবাহ নেই। শুকিয়ে আছে একরের পর একর জায়গা। শুকনো খালের রেখা দেখে চিহ্নিত করা হচ্ছে করতোয়ার অস্তিত্ব। কিছুদূর পর পানির দেখা মেলে ঠিকই। আবার তা কিছুদূর গিয়ে হারিয়েও যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আশির দশকে স্লুইস গেট নির্মাণের কারণে এ নদী ভরাট, দখল ও দূষণের শিকার হয়। এ নদীতে এখন আর বড় বড় মাছ পাওয়া যায় না। কৃষি সেচে কোনো কাজে আসছে না নদীর পানি। জলজ প্রাণীও এখন আর দেখা যায় না। এ অঞ্চলে মানুষের চর্মরোগ দেখা যাচ্ছে। এমন অনেক পরিবার আছে যাদের এ নদী ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। নদীতে দূষণ বাড়ছে। পৌরসভার তরল বর্জ্যগুলো নদীতে পড়ছে। শহরের সব আবর্জনা এখানে এসে পড়ছে। নিকটবর্তী ছোট-বড় সব কলকারখানার বর্জ্যও এখানে পড়ছে। বদলে যাচ্ছে নদীকেন্দ্রিক প্রতিবেশও।’
অথচ শতকের পর শতক ধরে নদীটি পরিচিত ছিল উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত, প্রমত্তা ও স্রোতস্বিনী নদী হিসেবে। নদীর পশ্চিম তীর ঘেঁষে গোড়াপত্তন হয়েছিল দেশের অন্যতম প্রাচীন জনপদ পুন্ড্র নগরীর। করতোয়ার ডান তীর ধরেই তিব্বতে ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন বখতিয়ার খলজী। এ অভিযানের বিবরণে করতোয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে গঙ্গার চেয়ে তিনগুণ প্রশস্ত নদী হিসেবে। নদীর খরস্রোতে মুঘল সেনাপতি মীর জুমলার অগ্রাভিযানও থেমে গিয়েছিল।
১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের প্রাদেশিক ওলন্দাজ শাসনকর্তা ভ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রে করতোয়াকে দেখানো হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে সংযুক্ত এক বড় নদী হিসেবে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রন্থেও প্রাচীনকালে এ নদীর বিশালতা ও প্রখরতার বিবরণ আছে। বগুড়া জেলা গেজেটিয়ারেও এসব বিবরণের সমর্থন পাওয়া যায়।
শিবগঞ্জ, শেরপুর, শাজাহানপুর ও সদর—বগুড়া জেলার এ চার উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে করতোয়া নদী। স্থানীয়রা জানান, নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত এলাকাগুলোর অর্থনীতি আবর্তিত হয়েছে প্রধানত করতোয়াকে কেন্দ্র করে। এসব এলাকায় কৃষির সেচে ব্যবহার করা হতো এ নদীর পানি। স্থানীয়দের বড় একটি অংশ জড়িত ছিলেন মাছ ধরার পেশায়। জেলেদের সেই মাছ বগুড়ার রাজাবাজারের আড়ত থেকে বিক্রি হতো পাশের জেলাগুলোয়। বর্তমানে এ বাজারই বন্ধ হয়ে গেছে।
বগুড়া সদরের বউবাজার, নাটাইপাড়ার বাসিন্দা মিলন বলেন, ‘দখল ও দূষণে করতোয়া নদী মরে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে পানি থাকলেও অন্যান্য সময় পানিশূন্য থাকে এ নদী। এর ফলে এ এলাকার এক সময়ের বড় আড়ত রাজাবাজার বন্ধ হয়ে গেছে। এর সঙ্গে জড়িত মানুষজনও পেশা বদল করেছে।’
নব্বই দশক পর্যন্ত প্রায় চার হাজারের মতো জেলে বাস করত করতোয়া নদীর তীরবর্তী চেলোপাড়ায়। নদীতে মাছ না থাকায় এখন তাদের বড় একটি অংশ পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে থাকলেও তারা বাধ্য হয়েছেন অন্যান্য পেশার সঙ্গেও যুক্ত হতে।
এমনই এক ব্যক্তি আনন্দ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘আমার সংসার চলত করতোয়া নদীতে মাছ ধরে। কিন্তু এখন কোনো দিন এক-দুই কেজি মাছ পাই। কোনো দিন তাও পাই না। তাই সপ্তাহে একদিন মাছ ধরি। বাকি দিনগুলোয় ভ্যান চালানোসহ অন্যান্য কাজ করে থাকি। বছরের অধিকাংশ সময়ের চিত্রটি এমন। তবে বর্ষাকালে পানি বেড়ে যায় করতোয়ার। সে সময় জালে বেশি মাছ ধরা পড়ে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘বাংলাদেশের নদ-নদী: উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল’ শীর্ষক গ্রন্থের ২০১১ সালে (দ্বিতীয় সংস্করণ) তথ্য অনুযায়ী, করতোয়া নদীটি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার মিলনপুর ইউনিয়নে দেওনাই-চাড়াল কাটা-যমুনেশ্বরী নদী থেকে উত্পত্তি হয়ে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নে বাঙ্গালী নদীতে পতিত হয়েছে। উত্পত্তিস্থল থেকে করতোয়া নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১২২ কিলোমিটার।
নদীটির বর্তমান দুরবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় দখলদারদের উপদ্রবকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার জেলা শহরের চেলোপাড়া, উত্তর চেলোপাড়া, মালতীনগর, ফুলবাড়ী, মাটিডালি, রাজাবাজার, ফতেহ আলী সেতু, মহাস্থানগড় এলাকায় দখলের হার সবচেয়ে বেশি। উল্লেখিত এলাকায় দখল অব্যাহত রয়েছে।
২০১৯ সালে বগুড়ায় নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়-জলাধারের অবৈধ দখলে অভিযুক্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করে জেলা প্রশাসন। এতে বগুড়া সদর এলাকায় নদীর জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলার দায়ে অভিযুক্ত করা হয় বগুড়া ডায়াবেটিক হাসপাতাল, টিএমএসএসের আধাপাকা ঘর, টিএমএমএসের গেট, পাবহারা জামে মসজিদ, কুলশিহার পূর্ব ও পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদ, সনাতন সংঘ, রাধা গোবিন্দ মন্দির, ধলাহার যুব সংঘ, কল্যাণপুর উত্তরপাড়া ইছালে ছওয়াব কমিটি, গিরাইল মত্স্যজীবী সমবায় সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে।
টিএমএসএসের বিরুদ্ধে নদীর জমি দখলের অভিযোগটি মানতে নারাজ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা। তিনি বলেন, ‘টিএমএসএস থেকে যখন কেউ কোনো ধরনের সুবিধা চেয়ে পায় না তখনই তারা আমাদের বিরুদ্ধে নদী দখলসহ অন্যান্য অভিযোগ করে থাকে। তবে নদী দখলের বিষয়ে স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমরা নদী দখল করিনি। বরং মনুষ্যসৃষ্ট কারণে আমাদের জমি নদী গহ্বরে চলে গেছে। সেটিই আমরা উদ্ধারের চেষ্টা করছি। করতোয়ার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এক সময় এ নদীতে পালতোলা নৌকা যেত। আমি চাইব এ নদী তার হারানো অবস্থা ফিরে পাক।’
আবার তীরবর্তী অনেকেই সবজি চাষসহ নানাভাবে নদীটি দখল করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দূষণে স্থানে স্থানে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে নদীর পানি। স্থানীয়দের অভিযোগ, বগুড়া সদরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একেবারেই অপরিকল্পিত। তরল ও কঠিন—দুই ধরনের বর্জ্যই ফেলা হচ্ছে করতোয়া নদীতে। নদীতে গৃহস্থালির পাশাপাশি এসে যুক্ত হচ্ছে কলকারখানার বর্জ্যও। কিছু কলকারখানার বর্জ্য সরাসরি এসে পড়ছে করতোয়ায়। আবার কিছু নদীতে বর্জ্য ফেলছে রাতের আঁধারে। নদীর পানির রঙ এখন পুরোপুরি কালো। স্বাভাবিক জলজ প্রাণিসম্পদের পরিবর্তে নদীটি এখন হয়ে উঠেছে মশা-মাছিসহ নানা কীটপতঙ্গের আবাসস্থল। পানি হয়ে পড়েছে বিষাক্ত। নদীর এ বেহাল অবস্থা বগুড়ার চারটি উপজেলার পরিবেশে বিরূপ প্রভাব তৈরির পাশাপাশি স্থানীয়দের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করেছে।
বর্তমানে করতোয়া নদী রক্ষায় পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সচেতন নাগরিক কমিটি, সুপ্র ইত্যাদি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘করতোয়াকে আমার কাছে মনে হয় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একটি নদী। নদীটিকে প্রাথমিকভাবে মেরে ফেলেছে পাউবো। তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণের কথা বলে রেগুলেটর বসানোয় পানির প্রবাহ কমেছে। এর সুযোগে বিভিন্ন মহল এটিকে দখল করছে। স্থানীয় কিছু মানুষ এখানে যেমন কৃষিকাজ করছে, তেমনিভাবে বেশ প্রতাপশালী কয়েকটি গোষ্ঠীও নানা অজুহাতে এ নদীকে দখল করছে। এমনকি জাল দলিলও তৈরি করেছে। এ নদীকে যদি আমরা জীবন্ত সত্তা মানি, তাহলে এটি বলতে দ্বিধা নেই; নদীটি আসলে মৃত্যুর পথে। সরকার যদি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত, তাহলে কোনো সংগঠনের পক্ষেই এ নদী দখল করা সম্ভব হতো না। এ নদীকে বাঁচাতে অনতিবিলম্বে রেগুলেটর সরিয়ে দিতে হবে। নদীতে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যত দখলদার আছে কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের উচ্ছেদ করতে হবে। দূষণকারীদের কড়া নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন বলেন, ‘করতোয়া নদীর অবস্থা খারাপ হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো দখল ও দূষণ। কেননা বগুড়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে সব বর্জ্য গিয়ে করতোয়ায় পড়ে। তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) করতোয়ার দুই ধারে ড্রেন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছি। একই সঙ্গে করতোয়াকে বাঁচাতে ১২৩ কিলোমিটার খননের জন্য পাঁচ বছর আগে আমরা একনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। যদিও এ নদী খননের কথা ২০১০ সাল থেকেই চলছে। কিন্তু আজও তা আলোর মুখ দেখেনি। দখলের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা ৩৪ দখলদারের মধ্যে ২৮ জনকে উচ্ছেদ করেছি। বগুড়া জেলা প্রশাসন থেকে কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যদিও অনেক সময় পারা যায়নি। তবে আমাদের বর্তমান জেলা প্রশাসক আগের সবকিছু ভুলে নতুনভাবে কাজ শুরু করতে বলেছেন। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী করতোয়া নদী মাপা হচ্ছে। ঈদের পরই আমরা পুরোদমে নদীর উদ্ধার কার্যক্রম চালাব।’
আইএ/ ১৪ এপ্রিল ২০২৩