জাতীয়

সর্বস্ব খুইয়ে মুষঢ়ে পড়েছেন হাজারো ব্যবসায়ী

ঢাকা, ০৪ এপ্রিল – করোনা মহামারির কারণে গত দুই ঈদে আশানুরুপ ব্যবসা করতে পারেননি বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। এবার ঘুরে দাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তারা। আসন্ন ঈদ ঘিরে বিনিয়োগও বাড়ানো হয় অনেক। কিন্তু সাড়ে ৬ঘণ্টার অগ্নিকাণ্ডে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাজারো ব্যবসায়ী। এখানে যাদের দোকান ছিল তারা তো সব হারিয়েছেনই, একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন পণ্য উৎপাদনকারীরাও।

ঈদের আগে যখন বেচাকেনা জমতে শুরু করছে, ঠিক সেই সময় বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো। অনেকেই ঈদকে কেন্দ্র করে দোকান ও গোডাউনে মালামাল মজুদ রেখেছেন। সেসব জিনিসপত্র পুড়ে যাওয়ায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে দোকান থেকে কিছু মালামাল উদ্ধারের চেষ্টাও করেছেন। আগুনে মালামাল পুড়ে যাওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

আল মোক্তার গার্মেন্টস। অনেকেই বলছেন মার্কেটে সব থেকে বড় দোকানগুলোর একটি। তাদের মার্কেটে দোকান আছে চারটি ও তিনটি গোডাউন। দোকান ও গোডাউন মিলে ৭-৮ কোটি টাকার মালামাল ছিল। ঈদ উপলক্ষে আনা হয়েছে অধিকাংশ পোশাক। একটি দোকানের দায়িত্বে আছেন আব্দুল আহাদ। বাকিগুলো বাবা, চাচারা দেখাশোনা করেন। দোকানে থাকা ক্যাশবাক্স বাঁচাতে নিয়েছিলেন জীবনের ঝুঁকি কিন্তু লাভ হয়নি তার।

পোড়া মার্কেটের পাশে বসে বিলাপ করছিলেন আহাদ। তিনি হোয়াটসঅ্যাপ দেখিয়ে বলেন, আজ মঙ্গলবার ছয় লাখ টাকার মাল ডেলিভারি দেবার কথা ছিল।

ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, আমার বাড়ি বঙ্গবাজার মার্কেটের পাশেই। সকাল সাড়ে সাতটায় এলার্ম দেয়া। সাড়ে ছয়টার সময় চিল্লাচিল্লি। বাইরে বের হয়ে দেখি ধোঁয়া উড়তেছে। তাড়াতাড়ি মার্কেটে আসি। তখনও আমার এক দোকানে পুরোপুরি আগুন লাগে নাই। আমি দৌঁড় দিয়া দোকানে যাই, ক্যাশ বাক্স আনার জন্য। কিন্তু দোকানের কাছে যাইতেই উপরের তালার একটা এসি বিস্ফোরণ হয়। আমার হাতে, পিঠে আগুনের ছ্যাকা লাগে। পুড়ে যায়। তাও আমি যাব ভিতরে কিন্তু দোকানদার এক চাচা আমারে টাইনা বাইরে নিয়া আসে।

তিনি তার ক্ষতস্থান দেখিয়ে বলেন, বাইরে আসার সাথে সাথেই উপর থেকে বিল্ডিংয়ের একটা অংশ খসে পড়ে। চাচা আমারে বাইর না করলে আমার মাথায় পড়ত। এরপরও ভিতরে যাইতে চাইছিলাম। ক্যাশে আমার ১৭-১৮ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে আগুন লেগে যায়। এরপর আমি ভিতরে যাই আগুনের অংশ লাফ দিয়া কিন্তু ক্যাশবক্স আর খুঁইজা পাই নাই। এর উপর অনেক ইট, পলেস্তারা পড়ে আছে। কিন্তু আগুনের তাপ থাকায় আর বেশি সময় থাকতে পারি নাই।

বঙ্গবাজারের দোকানিদের মূলত বাকিতে মালামাল সরবরাহ করেন উৎপাদকরা। দোকানিরা মালামাল বিক্রি করে ধাপে ধাপে সেসব টাকা পরিশোধ করেন। আর সে কারণে ভয়াবহ আগুনে বঙ্গবাজারের দোকানিদের পাশাপাশি নিঃস্ব হয়েছেন গার্মেন্ট পণ্য তৈরির সঙ্গে জড়িত অসংখ্য ব্যবসায়ী।

তাদেরই একজন রুবেল হোসেন। মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে ভষ্মীভূত বঙ্গবাজারের পাশে ফুটপাতে বসে খোলা আকাশের নিচে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন এই ব্যবসায়ী। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, তিনি যেসব দোকানে পোশাক সরবরাহ করতেন সেসব দোকানের উদ্ধার করা মালামাল পাহারা দিচ্ছেন তিনি।

দোকানিদের মালামাল পাহারা দিতে আপনি ছুটে এসেছেন কেন- এমন প্রশ্নে রুবেল বললেন, ‘এসব আমারই মালামাল। ৭টা দোকানে আমি রেগুলার মাল দেই। আমার লেডিস ওয়ান পিস আইটেম তৈরির ব্যবসা আছে। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়িতে আমার কারখানা। আমি মাল বানিয়ে বঙ্গবাজারে ৭টা দোকানে সাপ্লাই দেই। আমার ৫০ লাখ টাকার মাল দেয়া ছিল। সব শেষ। পাশেই গোডাউনে কিছু মাল ছিল, তা বাইরে আনা হইছে। আমি সেগুলা পাহারা দিচ্ছি।’

ব্যবসা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে রুবেল বলেন, ‘আমাদের লাইনে নগদের চেয়ে বাকিতে ব্যবসা চলে বেশি। ধরেন আমি কোনো দোকানে এক লাখ টাকার অর্ডার নিলাম। মাল ডেলিভারির সময় হয়তো ১০ হাজার দিলো। বাকিটা সপ্তাহে সপ্তাহে মাল বিক্রি করেএখানকার পাইকার আমারে দেয়। আমার এভাবে ৫০ লাখ টাকার মাল দেয়া ছিলো এইখানে। এখন দোকানদারের তো সবই গেলো; তার সাথে আমারও গেলো।’

এই ক্ষতি পোষাবেন কিভাবে জানতে চাইলে রুবেল বলেন, ‘আল্লাহ জানেন। দেখি কী হয়। পরিস্থিতি একটু ভালো হোক। তারপর দোকান মালিকদের সাথে বসে আলোচনা করে যা করা যায় দেখা যাবে। দোকানদারেরও তো সব গেছে। আমি তো আর তারে চাপ দিতে পারি না। সে যতটুকু আস্তে ধীরে দিতে পারবে সেটাই মানতে হবে।’

রুবেলের মতোই খোলা আকাশের নিচে দোকানিদের মালামাল নিয়ে বসে থাকা পণ্য উৎপাদক গফুর মিয়া বলেন, ‘আমি গতকাল রাতেও ৭০ লাখ টাকার ঈদের চালান দিয়ে গেছি। গতকাল একবার মনে হয়েছিলো মাল দুই দিন পর দেই। কিন্তু দোকানদারের চাপে রাতেই ডেলিভারি দিলাম। আর সকালেই সব শেষ। এখন কিভাবে কী করব, কত টাকা তুলতে পারব- কিছুই জানি না। খবর পেয়ে বাসায় আর থাকতে পারিনি। এসে দোকানদারদের সাহায্য করছি। তারা তো শেষ! তাদের সাথে আমরাও। এখন তাদের পাশে না থাকলে কখন থাকব?’

সূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এম ইউ/০৪ এপ্রিল ২০২৩

Back to top button