বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

যে কারণে সাইবার অপরাধের মামলা বেশিরভাগ প্রমাণ করা যায় না

জামাল উদ্দিন

তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে দিন যত যাচ্ছে, সাইবার অপরাধ তত বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে মামলার সংখ্যাও। মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে নিষ্পত্তির সংখ্যা খুবই কম। তারপরও পুলিশ ও সাইবার ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, কিছু সমস্যা ও জটিলতার পরও সাইবার ট্রাইব্যুনালে যত দ্রুত ও যত বেশি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটা অন্য আদালতের তুলনায় বলা যায় রেকর্ড। সাক্ষীদের উপস্থিতিও অন্যান্য মামলার চেয়ে সন্তোষজনক। এছাড়া মাত্র কয়েকমাস আগে নিজস্ব এজলাস পেয়েছে সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এর আগে অন্য আদালতের বিচার কাজ শেষে ট্রাইব্যুনালের কাজ চালানো হয়েছে। সে কারণেও মামলা নিষ্পত্তিতে শুরুর দিকে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। তদন্তের দুর্বলতাসহ বিভিন্ন জটিলতার পাশাপাশি চুক্তি না থাকায়, ফেসবুকের আর্কাইভ থেকে কোনও তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। যে কারণে সাইবার অপরাধের অনেক মামলা প্রমাণ করা সম্ভব হয় না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৩ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হওয়া দুই হাজারের বেশি মামলা বিচারের জন্য এসেছে ট্রাইব্যুনালে। এরমধ্যে প্রথম বছর ২০১৩ সালে মামলা হয়েছিল মাত্র তিনটি। ২০১৪ সালে ৩৩টি, ২০১৫ সালে ১৫২টি, ২০১৬ সালে ২৩৩টি, ২০১৭ সালে ৫৬৮টি, ২০১৮ সালে ৬৭৬টি, ২০১৯ সালে ৭২১টি এবং ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এসেছে ২৫৬টি মামলা। এসব মামলার মধ্যে রায় হয়েছে মাত্র ১২৪টির। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৩৫টি মামলায়৷ নিষ্পত্তি করা হয়েছে প্রায় এক হাজার ১০০ মামলা৷ বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দুই হাজার ২০০টির মতো। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৮৯টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এছাড়া অভিযোগ গঠনের শুনানির সময়েও তথ্য-উপাত্ত না থাকায় মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন ২ শতাধিক মামলার আসামিরা।

আরও পড়ুন : ভাঙচুর হওয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাস্কর্যের সামনে ফাঁকা গুলি

গত ২০১৮ সাল থেকে ট্রাইব্যুনালে সরাসরি মামলা দায়ের করা হয়েছে এক হাজার ৮২টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৪৯টি, ২০১৯ সালে ৬৬৮টি ও চলতি বছরে ১৬৫টি মামলা ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা হয়। এই এক হাজার ৮২টি মামলার মধ্যে ৪৪৭টি মামলা তদন্তের জন্য বিভিন্ন সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ৬৩৫টি মামলায় প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত না থাকায় আদালত খারিজ করে দেয়। ৪৪৭টি মামলার মধ্যে দেড় শতাধিক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আদালতে জমা দিয়েছে।

সাক্ষী হাজির করতে না পারাসহ কী কী কারণে মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, ‘সাইবার মামলার ক্ষেত্রে এমনটি হচ্ছে না। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তির এই সময়ে দিন যত যাচ্ছে সাইবার অপরাধ তত বাড়ছে। এটা পুরো বিশ্বজুড়েই হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে সচেতনতা হচ্ছে পরিত্রাণের অন্যতম উপায়। একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে তথ্য আদান- প্রদানে সতর্ক থাকতে হবে। এজন্যও আমরা কাজ করছি। সভা-সেমিনারে যাচ্ছি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আমাদের প্রোগ্রাম হচ্ছে। এনজিওগুলো প্রোগ্রাম করছে। সেখানে গিয়েও আমরা কথা বলছি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছি। আপনাদের নিউজের মাধ্যমেও সচেতনতার আহ্বান জানাচ্ছি ‘

সাইবার অপরাধের মামলা পরিচালনায় কী ধরনের সমস্যা, জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা কিবরিয়া বলেন, ‘সাইবার মামলার তদন্ত পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর। ফরেনসিক পরীক্ষায় প্রমাণ করা না গেলে, সেই মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।’ সাক্ষীর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ধরুন, আমি একটা মামলার তদন্ত করলাম। এই মামলার সাক্ষী হচ্ছেন গাজীপুরের। সেই সাক্ষীকে হাজির করার দায়িত্ব মূলত কোর্ট পুলিশ ও স্থানীয় পুলিশের। তদন্ত সংস্থার নয়। তবে সাক্ষীর কারণে আমাদের মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হচ্ছে, সেটা মনে হয় ঠিক না। সাইবার অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে অন্তত এটা হচ্ছে না।’

আরও পড়ুন : ফোর্বসের ‘আন্ডার এ বিলিয়ন’ তালিকায় ৩ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান

একই বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর) নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না, বা সাক্ষীর কারণে মামলা বিলম্বিত হচ্ছে, এমনটা ঠিক নয়। আমরা যেসব সাক্ষীকে সমন দিচ্ছি, তারা ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষী দিচ্ছেন। অনেক সময় ঢাকার বাইরের ভিন্ন জেলার সাক্ষীরা বিভিন্ন সমস্যার কারণে সময় মতো্ আসতে পারেন না। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ঠিকই এসে সাক্ষী দিচ্ছেন। আমাদের মামলা যত দ্রুত সাক্ষী ও নিষ্পত্তি হচ্ছে, এমনটি খুব কম কোর্টেই হয়। প্রায় প্রতিদিনই আমরা বিভিন্ন মামলায় তিন থেকে চার জন সাক্ষী নিয়ে থাকি। আমরা যতগুলো মামলা নিষ্পত্তি করেছি, এটা ঢাকার আদালতগুলোরে ক্ষেত্রে রেকর্ড। অন্য কোনও আদালতে এত দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।’

রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, ‘শুরুর দিকে সাইবার ট্রাইব্যুনালের কোনও এজলাসই ছিল না। আরেকটা এজলাসের কাজ শেষ হলে সেই এজলাসে আমরা বিচার কাজ চালিয়েছি। যে কারণে শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু গত তিন মাস আগে আমরা নিজস্ব এজলাস পেয়েছি। এখন দ্রুততার সঙ্গেই সবকিছু হবে, ইনশাআল্লাহ। বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ২০০ মামলা বিচারাধীন আছে।’

তিনি জানান, নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, মেয়েদের হ্যারাসমেন্ট, মনোমালিন্যের পর নিজের স্ত্রীর আপত্তিকর ছবি অনলাইনে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেওয়া এবং জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় সাজা হয়েছে। কিছু মামলায় বাদী-বিবাদীর সমঝোতা হয়ে যাওয়া ও তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত ঠিকমতো দিতে না পারার কারণেও নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। তাছাড়া ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় তাদের আর্কাইভ থেকে মামলার আলামত সংগ্রহ করা যায় না।

সুত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এ/ ০৫ ডিসেম্বর

Back to top button